ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিপ্রার্থীকে সুবিধা দিতে ‘ভিসির কথোপকথন’ ফাঁস

কথোপকথনে এক চাকরিপ্রার্থীকে শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড স্থগিতের কারণ ব্যাখ্যা ও পরবর্তী নিয়োগ বোর্ড অনুষ্ঠিত করার আশ্বাস দেন উপাচার্যের ‘কণ্ঠসদৃশ’ ওই ব্যক্তি।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: সংগৃহীত

কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শেখ আবদুস সালামের ‘কণ্ঠসদৃশ’ কথোপকথনের তিনটি অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

কথোপকথনের ক্লিপগুলোতে এক চাকরিপ্রার্থীকে শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড স্থগিতের কারণ ব্যাখ্যা ও পরবর্তী নিয়োগ বোর্ড অনুষ্ঠিত করার আশ্বাস দেন উপাচার্যের (ভিসি) ‘কণ্ঠসদৃশ’ ওই ব্যক্তি। একই সঙ্গে প্রার্থীকে বোর্ডের প্রশ্ন সরবরাহ ও কীভাবে লিখতে হবে, সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ ও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বলা হয়। সবকিছু ঠিক থাকলে ৩০ দিনের মধ্যে বোর্ডের আয়োজন ও বোর্ড সম্পন্ন করতে টাকার বিনিময়ে বোর্ডে তিনজন সদস্য প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয় কথোপকথনে।

কথোপকথনগুলো ফেসবুকে ছড়ানোর ২৪ ঘণ্টা পর শুক্রবার রাতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানায় গিয়ে জিডি করেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এইচ এম আলী হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভিসি স্যার আমাকে জিডি করতে বলেছেন, তাই ইবি থানায় জিডি করেছি। অডিও পোস্টদাতার অ্যাকাউন্টটি শনাক্ত করতে জিডি করা হয়েছে। অডিও কার এটা তো আমি জানি না, এটা প্রশাসন বের করবে।’

গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দিনের বিভিন্ন সময় ‘ফারাহ জেবিন’ নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে কথোপকথনের তিনটি অডিও পোস্ট করা হয়। এগুলোর প্রথমটি ৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডের, দ্বিতীয়টি ১ মিনিট ৪৯ সেকেন্ড ও তৃতীয়টি ২ মিনিট ১৯ সেকেন্ডের। অডিওতে কথা বলা কণ্ঠটি উপাচার্য শেখ আবদুস সালামেরই কি না, সেটি যাচাই করতে পারেনি প্রথম আলো।

অডিও তিনটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম বিভাগের নিয়োগ বোর্ড স্থগিতের বিষয় নিয়ে নিয়োগপ্রার্থী ও বর্তমানে ওই বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক অলিউর রহমানের সঙ্গে উপাচার্যের ‘কণ্ঠসদৃশ’ ওই ব্যক্তির আলাপন হয়। তবে অডিওতে অলিউর রহমানের কথা শোনা যায়নি।

গত ২৫ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড অনুষ্ঠিত হয়। এতে সহকারী অধ্যাপক পদে আবেদন করেন অলিউর রহমানসহ মোশারফ হোসেন ও বিউটি মণ্ডল নামের আরও দুজন প্রার্থী। এ সময় বোর্ডে তিন প্রার্থী উপস্থিত না হওয়ায় বোর্ড স্থগিত হয়। পরে গত ২ ডিসেম্বর আবারও বিজ্ঞপ্তি দেয় কর্তৃপক্ষ। ২২ ফেব্রুয়ারি ওই নিয়োগ বোর্ড অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়।

ফেসবুকে দেওয়া প্রথম অডিওর পোস্টের ক্যাপশনে পোস্টদাতা লিখেছেন, ‘গত ২৫ অক্টোবর ২০২২ গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় তাঁর পছন্দের প্রার্থী অলিউর রহমান অলিকে নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় পুনর্বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেই প্রার্থীকে আবার নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রশ্ন সরবরাহ করছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. শেখ আবদুস সালাম।’

অডিওতে উপাচার্যের ‘কণ্ঠসদৃশ’ ব্যক্তিকে অপর প্রান্তের ব্যক্তির উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, নিয়োগ বোর্ডে উপস্থিতির জন্য যেন টাকার বিনিময়ে তিনজন প্রার্থী জোগাড় করা হয়। তাঁরা শুধু বোর্ডে অংশ নেবেন। বিষয়টি নিয়ে ট্রেজারারের (কোষাধ্যক্ষ) সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে বলে জানানো হয় অপর প্রান্তের ব্যক্তিকে। অডিওটির শেষাংশে ইঙ্গিত দিয়ে বোঝানো হয়েছে ‘আচ্ছা আপনি সব দিয়ে রেডি থাকেন। যেদিন সব দিয়ে দেবেন, তার ঠিক ২১ দিনের মাথায় সবকিছু গোছায় দেব।’

অডিওর দ্বিতীয় পর্বের ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘এভাবেই নিয়োগ বোর্ডের আগে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন ফাঁস করেন ড. শেখ আবদুস সালাম।’ ওই অডিওর ভাষ্যমতে অপর প্রান্তের ব্যক্তিকে, কোন কোন ধরনের প্রশ্ন পরীক্ষায় আসবে, কীভাবে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, কতটুকু কোন বিষয়ে লিখতে হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

তৃতীয় পর্বের অডিওটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, পরীক্ষায় কোথা থেকে প্রশ্ন আসবে সেই সূত্র এবং উত্তর ইংরেজিতে লেখার প্রস্তুতি রাখতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং তাঁকে বুঝিয়ে বলার পরামর্শ দেওয়া হয়।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আন নূর যায়েদ বলেন, ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া অডিওর ঘটনায় গতকাল রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার থানায় এসে জিডি করেছেন। সেখানে একটি আইডি থেকে ভিসির ‘কণ্ঠসদৃশ’ অডিও ফাঁস হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শেখ আবদুস সালাম ক্যাম্পাসের বাইরে আছেন। এ বিষয়ে কথা বলতে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হলে তিনি সাড়া দেননি।

এদিকে কথোপকথনের অডিও ছড়ানোর পর উপাচার্য শেখ আবদুস সালামকে ‘দুর্নীতিবাজ’ আখ্যা দিয়ে তাঁর কার্যালয়ে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-কর্মীরা। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরি করেন।

অস্থায়ী চাকরিজীবী পরিষদ ব্যানারে তাঁরা গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে প্রশাসনিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত উপাচার্যের কার্যালয় তালাবদ্ধ করে দেন। এ সময় বিক্ষোভকারীরা উপাচার্যের অপসারণ দাবি করেন এবং তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন।