সংগ্রহশালা
বাদ্যযন্ত্রের দোকান থেকে জাদুঘর
রেজাউলের বাবা জালাল উদ্দিন মারা যান ২০২১ সালে। এরপর রেজাউলকে সবকিছুর দায়িত্ব বুঝে নিতে হয়।
নবাব আলী সংগীতপ্রেমী মানুষ ছিলেন। ১৯৪৪ সালে ময়মনসিংহ নগরের বড়বাজার এলাকায় ‘নবাব অ্যান্ড কোং’ নামে বাদ্যযন্ত্রের একটি দোকান দেন তিনি। সেটি ছিল ময়মনসিংহ শহরের বাদ্যযন্ত্রের দ্বিতীয় দোকান। কালের পরিক্রমায় সেই দোকান থেকে তৈরি হয়েছে বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহশালা বা জাদুঘর।
সংগ্রহশালাটি এখন দেখভাল করেন নবাব আলীর নাতি রেজাউল করিম। তিনি ময়মনসিংহ নগরের কাচিঝুলি ঈদগাহ মাঠের বিপরীত পাশে ২০ হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় সংগ্রহশালাটি পরিচালনা করছেন। এর নাম দিয়েছেন ‘এশিয়ান মিউজিক মিউজিয়াম’। দুর্লভ এমন জাদুঘর চালু করায় প্রশংসা মিলছে। সেই সঙ্গে বড় বাজার এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে নবাব অ্যান্ড কোং নামের বাদ্যযন্ত্রের দোকানটিও পরিচালনা করছেন রেজাউল। সেখান থেকে সংগীতপ্রেমীরা তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী বাহারি বাদ্যযন্ত্র ক্রয় করতে পারেন।
রেজাউলের বাবা জালাল উদ্দিন মারা যান ২০২১ সালে। মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত এসব কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলেন জালাল। তিনি মারা যাওয়ার পর রেজাউলকে সবকিছুর দায়িত্ব বুঝে নিতে হয়। বংশপরম্পরার এই গল্পে আরও দুটি চরিত্র আছে। তাঁরা হলেন রেজাউলের দুই মেয়ে জাওয়াতা আফনান ও জয়িতা অর্পা। তাঁরা সংগীত চর্চা এবং বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে পারদর্শী হয়ে মানুষের বাহাবা কুড়াচ্ছেন। জাওয়াতা ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগে পড়ালেখা করছেন। আর জয়িতা উচ্চমাধ্যমিক পড়ছেন ময়মনসিংহে। পাশাপাশি সংগীত শিখছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গান করছেন।
ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে দোকানে আসতেন রেজাউল করিম। তবে ১৯৯০ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর নিজেদের বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসায় আরও বেশি মনোযোগী হন। একপর্যায়ে নিজেই হয়ে ওঠেন নবাব অ্যান্ড কোং প্রতিষ্ঠানের প্রাণ। প্রাপ্তবয়সে বাবার ব্যবসার হাল ধরার কারণে বাদ্যযন্ত্রের প্রতি বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর। দেশীয় পুরোনো বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করে দোকানে তোলেন তিনি। ক্রমশ নিজের দোকানে লোকজ বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহ বাড়ানোটা তাঁর কাছে নেশায় পরিণত হয়। নবাব অ্যান্ড কোং প্রতিষ্ঠানে তখন বাউল ও লোকজ গানের শিল্পীদের আড্ডা বেড়ে যায়। বাউলদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে দেশের নানা প্রান্তে ছুটে গিয়ে সংগ্রহ করতে থাকেন নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র। সংগ্রহ অনেক বেড়ে গেলে রেজাউল নিজের দোকানের পাশে আরও একটি ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে নিয়ে যান সংগ্রহ করা সব বাদ্যযন্ত্র। এভাবে প্রথমে কিছুটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় রেজাউলের সংগ্রহ।
২০০৮ সালে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত জয়নুল উৎসবে (শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন) প্রথম রেজাউলের বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী হয়। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠানে নিজের বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনীর আমন্ত্রণ পেতে থাকেন। ২০১৬ সালে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবেও রেজাউলের পুরোনো বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী স্থান পায়।
রেজাউল করিম বলেন, বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত অনুষ্ঠানে প্রদর্শনের পর প্রথম একটি জাদুঘর করার চিন্তা মাথায় আসে। এরপর থেকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন সংগ্রহশালা তৈরির জন্য। ২০২০ সালে ময়মনসিংহ নগরের আঞ্জুমান ঈদগাহ মাঠের বিপরীত পাশে ভাড়াবাড়িতে প্রতিষ্ঠা পায় স্বপ্নের সংগ্রহশালা। বর্তমানে ৬০০ বাদ্যযন্ত্র তাঁর সংগ্রহশালায় আছে। তিনি আরও বলেন, এই সংগ্রহশালা ঘিরে শিল্প-সাহিত্যের নগরী ময়মনসিংহে তৈরি হচ্ছে নতুন বৃত্ত। বিভিন্ন সময় এখানে অনুষ্ঠিত হয় কবিতা পাঠের আসর, কবিদের জন্মদিন উদ্যাপন, বাউল বৈঠক, বাউল উৎসবসহ নানা ধরনের আয়োজন।
চলতি বছরের ১৮ মে রেজাউলের সংগ্রহশালায় প্রদর্শনী হয় পুরোনো বাদ্যযন্ত্রের। রেজাউল দাবি করেন, এই প্রদর্শনীতে ৩৬৫ বছরের পুরোনো সারিন্দা স্থান পায়। যেটি তিনি সংগ্রহ করেছিলেন কুড়িগ্রাম জেলার রহমান ফকিরের কাছ থেকে। প্রদর্শনীতে আরও ছিল লালমনিরহাট জেলার গুণধর বাবুর কাছ থেকে পাওয়া ৩০০ বছরের পুরোনো একটি সারিন্দা। এ ছাড়া ২৫০ ও ১৫০ বছরের পুরোনো লোকজ বাদ্যযন্ত্র ছিল।
রেজাউলের এশিয়ান মিউজিক মিউজিয়ামে আরও আছে ডুগডুগি, পাখোয়াজ, শিঙ্গা, বাঁশি, করতাল, মাদল, খঞ্জনি, ডফ, কাঁসর বা কাঁসি, ডুগিসহ লোকজ নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র। তিনি বলেন, সংগ্রহে থাকা এসব বাদ্যযন্ত্র দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তিনি সংগ্রহ করেছেন। বাউল শিল্পীদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে বিরল বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করতে ছুটে গেছেন দেশের নানা প্রান্তে। কখনো রান্নাঘরে; আবার কখনো গোয়ালঘরেও মিলেছে বিলুপ্ত এসব বাদ্যযন্ত্র।
পুরোনো বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহশালা করার পর এবার রেজাউলের স্বপ্ন ময়মনসিংহে একটি সংগীত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। রেজাউল জানেন, বিশ্ববিদ্যালয় করা কঠিন কাজ। তবুও তিনি তাঁর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আমৃত্যু চেষ্টা করে যাবেন।