সাত দশক ধরে সবজির চারা উৎপাদিত হয় কুমিল্লার যে গ্রামে
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার সমেশপুর গ্রাম। অন্য গ্রামে আবাদি জমিতে শাকসবজিসহ নানা ধরনের ফসলে ভরে থাকলেও সমেশপুরের চিত্র একেবারেই আলাদা। গ্রামটির মাঠে যত দূর চোখ যায়, শুধু সবজির চারা আর চারা। প্রতিটি জমিতে সারি সারি বেডে বাতাসে দোল খাচ্ছে নানা ধরনের সবজির চারা।
মঙ্গলবার সকালে গ্রামে ঢুকতেই বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মানুষের আনাগোনা চোখে পড়ল। তাঁদের অনেকেই এসেছেন পাশের বিভিন্ন জেলা থেকে। কাগজে-কলমে সমেশপুর নাম হলেও গ্রামটি ‘সবজির চারার গ্রাম’ নামেই বেশি পরিচিত। আগত ব্যক্তিদের প্রায় সবাই জানালেন, তাঁরা বাণিজ্যিকভাবে সবজি চাষি। এসেছেন সবজির চারা কিনতে।
কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক হয়ে বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়নের সাহেববাজার এসে সবজির চারার গ্রাম কোন দিকে জিজ্ঞেস করলেই যে কেউ দেখিয়ে দেবে। গ্রামের এক পাশে গোমতী নদী, অন্য পাশে প্রত্নস্থান রানি ময়নামতির প্রাসাদ। ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, মরিচ, শিম, লাউ, কুমড়া, ব্রকলিসহ অন্তত ২৩ ধরনের সবজির চারা পাওয়া যায় সেখানে। চারা বিক্রি শেষে আবার নতুন করে বীজ বপনের অপেক্ষায় থাকেন উৎপাদনকারীরা।
৫২ বছর বয়সী মীর শহিদুল্লাহকে জমি থেকে ফুলকপি ও বাঁধাকপির চারা সংগ্রহ করতে দেখা গেল। তাঁকে ঘিরে আছেন চারজন। সবাই চারা নিতে এসেছেন। তাঁদের একজন কুমিল্লা সদর দক্ষিণের সুয়াগাজী এলাকার আবদুল জলিল। বললেন, ‘১৪০০ টাকা কইরা ৬ হাজার পাতাকপির (বাঁধাকপি) চারা কিনছি। এইখানকার চারা সারা দেশের সেরা। গত ১৮ বছর ধইরা এই গ্রাম থ্যাইক্কা চারা কিনতাছি।’
মীর শহিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ৩০ শতাংশ জমিতে বীজ বপন করেছেন। এখন প্রতিদিন ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকার চারা বিক্রি করছেন। চলতি মৌসুমে ৪০ লাখ টাকার মতো বিক্রির আশা করছেন। এক হাজার চারার দাম ১ হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘আমরা ভালা বীজ দিয়া চারা বানাই। এর লাইগ্যা মাইনসে দূরদূরান্ত থাইক্যা চারার লাইগ্যা আহে। ইন্ডিয়ার লোক আইয়াও চারা নেয়। আমি ৩৪ বছর ধইরা করতাছি। এর আগে আমার বাপেও চারার ব্যবসা করছে।’
গ্রামের চারা উৎপাদনকারীরা বলেন, সাত দশকের বেশি সময় ধরে সমেশপুরে বাণিজ্যিকভাবে সবজির চারা উৎপাদিত হচ্ছে। আগস্ট থেকে ডিসেম্বর—এই পাঁচ মাসে কয়েক ধাপে শতাধিক চারা উৎপাদনকারী পরিবার ৭ থেকে ৮ কোটি টাকার চারা বিক্রি করেন। প্রতিবছরই সংখ্যাটা বাড়ছে।
চারা উৎপাদনকারী মোবারক হোসেনের জমিতেও ক্রেতাদের ভিড় দেখা গেল। তিনি এবার ৮২ শতাংশ জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজির চারা উৎপাদন করেছেন। মোবারক হোসেন বলেন, আগস্টের শুরুতে তাঁরা চারা উৎপাদনের কাজ শুরু করেন। তখন চারার দাম ভালো থাকে। কিন্তু এবারের হঠাৎ বন্যায় তাঁর ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখন বেশি করে চারা উৎপাদন করছেন। দাম ভালো থাকায় লাভের আশা করছেন। গ্রামের শিক্ষিত ছেলেরাও এ কাজে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
মোবারকের কাছে চারা কিনতে আসা কুমিল্লার তিতাসের ঘোষেরকান্দি গ্রামের আবদুর রহমান বলেন, ‘১৩ বছর ধরে এখান থেকে চারা নিচ্ছি। এখানকার চারার ফলন খুবই ভালো। আমি ১ হাজার টাকা দরে ১০ হাজার ফুলকপির চারা কিনেছি।’ নোয়াখালীর চাটখিল থেকে আসা আলী হোসেন (৬০) বলেন, তিনি ২৫ বছর ধরে এই গ্রাম থেকে চার নিয়ে এলাকায় আবাদ করেন।
সমেশপুরের অন্তত পাঁচজন চারা উৎপাদনকারী বলেন, কম সময়ে বেশি লাভ, চারা উৎপাদনে পূর্ব অভিজ্ঞতা, ভালো বীজ থেকে চারা উৎপাদন ও ক্রেতাদের আস্থার কারণে গ্রামের প্রায় সব জমিতে সবজির চারা উৎপাদন করা হচ্ছে। বর্তমানে অন্তত ১৫০ একর জমিতে চারা লাগানো হচ্ছে। সবজির চারা বিক্রি করেই গ্রামের সমৃদ্ধি বেড়েছে। এখন আশপাশের বিভিন্ন গ্রামেও বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার মানুষ সেখানে চারা নিতে আসেন।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলায় চলতি মৌসুমে ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকার সবজির চারা বিক্রি হবে। গত বছরও এমন বিক্রি হয়েছিল। যার বড় একটি অংশ সমেশপুর থেকে বিক্রি হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কুমিল্লার উপপরিচালক আইউব মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, সমেশপুর গ্রাম থেকে মৌসুমে ৭ থেকে ৮ কোটি টাকার চারা বিক্রি হয়। পুরো জেলায় তা প্রায় ২০ কোটি টাকা। তিনি নিজে সমেশপুরে গিয়ে রংপুর, বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলা থেকে চারা কিনতে আসা মানুষকে দেখেছেন। মূলত সেখানকার চারার গুণগত মান ভালো হওয়ায় বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ আসেন। মাঠপর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা ভালো চারা উৎপাদনে তাঁদের পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেন।