জেলার রাজনীতি—২৫: মেহেরপুর
প্রতিমন্ত্রী ফরহাদকে ঘিরে আওয়ামী লীগে কোন্দল
জেলা বিএনপিতে নানা বিষয় নিয়ে একসময় বিরোধ ছিল। কিন্তু এখন দ্বন্দ্ব ভুলে তাঁরা সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবির আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগে কোন্দল তীব্র রূপ নিয়েছে। কোন্দলের কেন্দ্রে আছেন মেহেরপুর-১ (সদর-মুজিবনগর) আসনের সংসদ সদস্য, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফরহাদ হোসেন। জেলা আওয়ামী লীগের বিরোধ ছড়িয়ে পড়েছে তিন উপজেলায়।
অন্য দিকে জেলা বিএনপি অতীতের সব দ্বন্দ্ব ভুলে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবির আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। জেলা বিএনপির সভাপতি মাসুদ অরুণের নেতৃত্বে এসব কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।
অন্তঃকোন্দলে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ
সম্মেলনের ১৩ মাস পর গত ২৮ জুন জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর আগে উপজেলা পর্যায়ের কমিটি গঠিত হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনকে কমিটিতে রাখা হয়নি। জেলা ও উপজেলা কোনো কমিটিতেই রাখা হয়নি সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রসুলকে। জেলা-উপজেলা কমিটিতে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রীসহ তাঁর ১৭ স্বজনকে রাখা হয়।
কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের না রাখা, প্রবীণ নেতাদের মূল্যায়ন না করাসহ নানা কারণে জেলা আওয়ামী লীগে এখন দুটি ধারা। একটির নেতৃত্বে প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। আরেকটির নেতৃত্বে আছেন গোলাম রসুল। ফরহাদ হোসেনের পক্ষে আছেন জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেক, যুগ্ম সম্পাদক ইব্রাহিম শাহিন, সহসভাপতি আবদুস সালাম, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বোরহান উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল ইসলাম প্রমুখ।
গোলাম রসুলের পক্ষে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মিয়াজান আলী, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইয়ারুল ইসলাম, মুজিবনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জিয়াউদ্দিন বিশ্বাস, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এস এম ইমন।
মিয়াজান আলী বলেন, ‘২০১৪ সালে হঠাৎ করে ফরহাদ হোসেন আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে আসেন। পরে দলের সভাপতির নির্দেশে প্রতিটি নেতা-কর্মী তাঁর পক্ষে নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি জয়লাভ করেন। এরপর থেকে ফরহাদ হোসেন ত্যাগী নেতাদের আর পাত্তা দেননি। তাঁকে আবার মনোনয়ন দিলে আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁর পক্ষে কাজ করবেন না।
গোলাম রসুল বলেন, ‘৩৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার পরও আমাকে দলের কোনো পদে রাখা হয়নি। জেলা পরিষদেও ফরহাদ হোসেন কৌশলে আমাকে পরাজিত করেন। জেলা আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার জন্য ফরহাদ হোসেন যেন মনোনয়ন না পান, সেই দাবিতে আমাদের আন্দোলন চলছে।’
জেলা কমিটিতে প্রতিমন্ত্রীর ১৭ স্বজনকে পদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ভগ্নিপতি বাবলু বিশ্বাস সহসভাপতি, বোন শামীম আরা মহিলাবিষয়ক সম্পাদক, স্ত্রী সৈয়দ মোনালিসা জেলা কমিটির সদস্য, একই পদে চাচাতো ভাই আমিরুল ইসলাম। এ ছাড়া বড় ভাই শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকবাল হোসেন, প্রতিমন্ত্রীর বাবার ফুপাতো ভাই বোরহান উদ্দিন সদরের সভাপতি, ফুপাতো ভাই সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল ইসলাম ফরহাদ হোসেন, ভাতিজা আদিব হোসেন মেহেরপুর সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি, ছোট ভাই জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সরফরাজ হোসেন।
গত বছরের ৯ মে মুজিবনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে রফিকুল ইসলামকে সভাপতি ও আবুল কালাম আযাদকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। বাদ পড়েন আগের কমিটির সভাপতি জিয়াউদ্দিন বিশ্বাস। পরে তিনি গোলাম রসুলের পক্ষে চলে যান। জিয়াউদ্দিন বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ফরহাদ হোসেন নিজের ইচ্ছেমতো দল পরিচালনা করেন। নিজের পরিবারের বাইরে কাউকে মূল্যায়ন করেন না। এসব কারণে মুজিবনগর আওয়ামী লীগে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।
মেহেরপুর-১ আসনে ফরহাদ হোসেনকে মনোনয়ন না দিতে ৩ অক্টোবর মেহেরপুর পৌর কমিউনিটি হলে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে বিশেষ মতবিনিময় সভা করেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা। জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সভায় জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মিয়াজান আলী, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইয়ারুল ইসলাম, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান, সদর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রসুল, মুজিবনগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জিয়াউদ্দিন বিশ্বাস, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল মান্নান প্রমুখ বক্তব্য দেন। তাঁদের মধ্যে মিয়াজান আলী, ইয়ারুল ইসলাম, গোলাম রসুল, আব্দুল মান্নান এবার মনোনয়নপ্রত্যাশী।
৩ অক্টোবর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সভার বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেক বলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে লিখিত আকারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটিকে জানানো হয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আমি মেহেরপুরের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর জেলায় চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, হয়রানি, নির্যাতন, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ নির্মূল করেছি। কোনো দল এখন সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা নিতে পারেন না। যাঁরা অবৈধ সুযোগ-সুবিধা চাইতেন, তাঁদের প্রশ্রয় না দেওয়ায় সম্প্রতি তাঁরা আমার বিরুদ্ধে সভা করে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, গোলাম রসুল জেলা পরিষদের নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় তিনি জেলা ও উপজেলা কোনো কমিটিতেই স্থান পাননি। এ কারণে আমার প্রতি তাঁর ক্ষোভ।’ পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের কমিটিতে রাখার বিষয়ে অভিযোগের বিষয়ে ফরহাদ হোসেন বলেন, তাঁর পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়রা নিজেদের যোগ্যতায় কমিটিতে স্থান পেয়েছে। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছেন।
এম এ খালেক ও মকবুল হোসেনের কোন্দলের কারণে গাংনী উপজেলা নিয়ে গঠিত মেহেরপুর-২ আসনে গতবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয় সাহিদুজ্জামানকে। এখন উপজেলায় আওয়ামী লীগে দুই পক্ষ রয়েছে। এক পক্ষের নেতৃত্বে সাহিদুজ্জামান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোখলেছুর রহমান। অপর পক্ষের নেতৃত্বে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেক ও সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন।
এম এ খালেক বলেন, ‘উপজেলা আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার কাজ ছিল সাহিদুজ্জামানের। কিন্তু তিনি নির্বাচনে জয় পাওয়ার পর হাতে গোনা কয়েকজন অনুসারীকে নিয়ে নিজের আলাদা বলয় তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন।’
মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান বলেন, উপজেলা পর্যায়ে নেতা–কর্মীদের মধ্যে বিভাজন থাকতে পারে। তবে সবাই কেন্দ্রের আদেশ অনুযায়ী মনোনীত প্রার্থীকে সমর্থন ও তাঁর হয়ে কাজ করতে বাধ্য থাকবেন।
মেহেরপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের কাছে ছুটছেন মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান, মোখলেছুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেক, সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক এ এস এম নাজমুল হক।
নিরুপায় হয়ে বিএনপিতে ঐক্য
একসময় জেলা বিএনপিতে তীব্র কোন্দল ছিল। জেলা কমিটির সহসভাপতি আলমগীর একটি পক্ষের নেতৃত্ব দিতেন। অন্য পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন বর্তমান সভাপতি মাসুদ অরুণ। ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারি ৩২ সদস্যবিশিষ্ট জেলা বিএনপির আংশিক কমিটিতে সভাপতি হন সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মাসুদ অরুণ ও সাধারণ সম্পাদক হন সাবেক সংসদ সদস্য আমজাদ হোসেন। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় ও হামলা মামলার কারণে এখন জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ।
জেলা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি মারুফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ সাল থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১৪৭টি মামলা হয়েছে। এখনো ৩৭ জন কারাগারে আছেন। মাসুদ অরুণ বলেন, ‘দেশে গণতন্ত্র ফিরে না আসা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম–লড়াই অব্যাহত থাকবে। এখন নির্বাচন নিয়ে আমরা ভাবছি না। সরকারকে উৎখাত করতে নিজেদের মধ্যে বিভেদ–অনৈক্য ভুলে আন্দোলনে জোর দেওয়া হচ্ছে।’
২০১৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রেজাউল হককে সভাপতি ও আসাদুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক করে গাংনী উপজেলা বিএনপির কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর দুই দিন পর আমিরুল ইসলামকে সভাপতি ও বদরউদ্দিন বিশ্বাসকে সাধারণ সম্পাদক করে মুজিবনগর উপজেলা বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়।
আমিরুল ইসলাম বলেন, একাধিক মামলা হয়েছে মুজিবনগর বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে। তারপরও কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। নির্বাচনের পরিবেশ যদি তৈরি হয়, তবে মাসুদ অরুণ মেহেরপুর-১ আসনে একক প্রার্থী হবেন।
মেহেরপুর-২ আসনে সক্রিয় আছেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি জাভেদ মাসুদ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, টানা ১৫ বছর ধরে বিএনপির নেতা–কর্মীদের নির্যাতন করা হয়েছে। মামলা, হামলা, হয়রানির শেষ নেই। বিএনপির লক্ষ্য এখন আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো। আন্দোলন সফল হলে বিএনপির প্রার্থিতা চূড়ান্ত করবে দল। দল তখন যাঁকে মনোনয়ন দেবে, তাঁর হয়ে নির্বাচন করবে সবাই।
জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আমজাদ হোসেন বলেন, আগের চেয়ে বিএনপি অনেক মজবুত। এখন নিজেদের মধ্যে বিভেদ করার সময় না। সমবেত হয়ে বৃহত্তর আন্দোলন করতে হবে।