‘এশিয়ার ক্ষুদ্রতম মা’ মাসুরা পেলেন নতুন দোকান, প্রথম ক্রেতা জেলা প্রশাসক

মাসুরার দোকান থেকে চকলেট কিনছেন রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ। আজ মঙ্গলবার সকালে রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলায়ছবি: প্রথম আলো

স্বামীর উচ্চতা ৫ ফুট ১ ইঞ্চি। স্ত্রী ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি। উচ্চতার এই ব্যবধান তাঁদের সংসারে কোনো সমস্যা তৈরি করেনি। ভালোবাসার রঙে রঙিন এই পরিবারে নতুন অতিথি হয়ে আসে মেয়ে মরিয়ম। গত ৯ বছরে সে উচ্চতায় মাকে ছাড়িয়ে গেছে। অভাব-অনটনের মধ্যেও তিনজনের সংসারে নেই ভালোবাসার কমতি। ছিল না তাঁদের একটি ঘর আর কর্মসংস্থানের সুযোগ।

অবশেষে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন মনিরুল ইসলাম ও মাসুরা খাতুন দম্পতিকে একটি দোকান করে দিয়েছে। আজ মঙ্গলবার রাজশাহীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) শামীম আহমেদ ছিলেন মাসুরার দোকানের প্রথম ক্রেতা। তিনি এক বয়াম চকলেট কিনে দোকানের উদ্বোধন করেন। এর আগে রাজশাহী জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের বজরাপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে নতুন ঘর পান তাঁরা।

জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, মাসুরা এশিয়ার সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম মা। বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমের মাধ্যমে নজরে আসে। এরপর তাঁকে নিজ কার্যালয়ে দাওয়াত করেন। সেখানে মাসুরার সঙ্গে কথা বলে বাড়ি ও দোকানের স্বপ্নের কথা জানতে পারেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে মুজিব বর্ষের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় তাঁর গ্রামেই একটি সুন্দর পাকা বাড়ি করে দেওয়া হয়েছে।

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। এই সংগঠনের মাধ্যমে মাসুরার মতো অনেক সুবিধাবঞ্চিত মানুষ সহযোগিতা পেয়েছেন। তাই মাসুরার দোকানের স্বপ্নপূরণে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন এগিয়ে এসেছে।

আরও পড়ুন

গাইবান্ধা সদর উপজেলার ধোপাডাঙ্গা গ্রামের মনিরুল ইসলাম (৪০) রাজশাহীর পবা উপজেলার বজরাপুর গ্রামের মাসুরা খাতুনকে (৩৫) বিয়ে করেছিলেন ১৯ বছর আগে। ইটভাটায় কাজ করতে পবায় এসেছিলেন মনিরুল। ইটভাটার পাশেই ছিল মাসুরার বাড়ি। তিনি তখন ইটভাটায় যাওয়া-আসা করতেন। একসময় মাসুরার প্রতি তাঁর মনে অদ্ভুত এক মায়া জন্ম নেয়। ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। একদিন তাঁরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। বিয়েতে ছেলের পরিবারের আপত্তি না থাকলেও বাদ সাধে মেয়ের পরিবার। তাদের মনে ভয় ছিল, বিয়ে করে ছেলে কয়েক দিন পর মাসুরাকে ফেলে না চলে যায়।

২০১৪ সালে মাসুরা খাতুনের সঙ্গে মনিরুল। কোলে তাঁদের মেয়ে
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

সব বাধা পেরিয়ে মনিরুল ও মাসুরা বিয়ে করেন। বিয়ের পর তাঁরা মাসুরার আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। একদিন মাসুরার পরিবারের লোকজন তাঁদের ওপর হামলার চেষ্টা করেছিলেন। তবে মনিরুল-মাসুরার ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত সব বাধাকে জয় করেছে। এক বছর, দুই বছর দেখতে দেখতে আট বছর পার হয়ে যায়। মেনে নেন মাসুরার চাচা। মনিরুলকে বাড়ি করতে একখণ্ড জমি দেন তিনি। সেখানে একটা ছোট্ট ঘর করে এখন বসবাস করছেন এই দম্পতি। তাঁদের এই ভালোবাসার গল্প ২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় ‘ভাটার জীবনে ভালোবাসার জোয়ার’ শিরোনামে ছাপা হয়।

পারিলা ইউনিয়নের বজরাপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে জেলা প্রশাসকের দোকান উদ্বোধন করতে আসার কথা জানতে পেরে মাসুরা রাত জেগে বিভিন্ন রঙের বেলুন ও রঙিন কাগজ-কাপড় দিয়ে সাজিয়ে তোলেন স্বপ্নের দোকানটি। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্বামী মনিরুল ও একমাত্র কন্যাশিশু মরিয়ম। মঙ্গলবার সকাল ১০টায় মাসুরার দোকানে প্রথম ক্রেতা হিসেবে আসেন জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ। তিনি রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও। তিনি চকলেটের বক্স কিনে তা আশ্রয়ণ প্রকল্পের শিশুদের মধ্যে বিতরণ করেন। এর আগে তিনি দোকানের ফলক উন্মোচন করেন।
দোকান পেয়ে খুশি মাসুরা খাতুন বলেন, মনিরুলের সঙ্গে বিয়ের অভিযোগে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় ভেসে বেড়াতে হয়েছে। জেলা প্রশাসক সেই দুঃখ দূর করেছেন। তাঁরা খুব খুশি।

মাসুরা খাতুন ও তাঁর মেয়ে মরিয়মকে সঙ্গে নিয়ে দোকান উদ্বোধন করেন অতিথিরা। আজ মঙ্গলবার সকালে রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলায়
ছবি: প্রথম আলো

দোকান উদ্বোধনের সময় উপস্থিত ছিলেন রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি কল্যাণ চৌধুরী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সরকার অসীম কুমার সরকার, রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন প্রামাণিক, রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য আকবারুল হাসান, পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সালেহ মোহাম্মদ হাসনাত, সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিজিত সরকার, জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সালাহ উদ্দীন-আল-ওয়াদুদ, পবা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবু বাশির, পারিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ আলী মোর্শেদ প্রমুখ।