শিল্পবর্জ্যে সাতটি হাওরে চাষাবাদ নিয়ে বিপাকে কৃষকেরা

এলাকার হাওর ও খাল–বিলগুলো শিল্পবর্জ্যে ছেয়ে যাওয়ায় এর পানিও ব্যবহার করা যাচ্ছে না

হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার রাজখালটি শিল্পকারখানার বর্জ্যে কালো হয়ে গেছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। গত রোববার তোলা
ছবি: প্রথম আলো

হবিগঞ্জের মাধবপুর ও লাখাই উপজেলায় শিল্পবর্জ্যে সাতটি হাওরে চাষাবাদ করতে পারছেন না চাষিরা। এ ছাড়া এলাকার হাওর ও খাল–বিলগুলো শিল্পবর্জ্যে ছেয়ে যাওয়ায় এর পানি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। 

এদিকে হাওর ও খাল–বিলের পানি দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের ওপর দায় চাপিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে। 

সরেজমিন এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাধবপুর উপজেলার শিবজয়নগর হাওরের মাঝখান দিয়ে একটি খাল প্রবাহিত হয়েছে। খালটি এলাকাবাসীর কাছে রাজ খাল হিসেবে পরিচিত। এ রাজ খাল পাশের সাতপাড়িয়া হাওর, এখতিয়ারপুর হাওর, পিয়াম হাওর ও সাকুসাইল হাওর হয়ে জেলার লাখাই উপজেলার মুড়াকরি কালাউক হয়ে কাস্টি নদে গিয়ে মিশেছে। ১২ থেকে ১৫ কিলোমিটার খালটি ঘিরেই ওই এলাকার কৃষিব্যবস্থা গড়ে ওঠে। কিন্তু সম্প্রতি এ খালের পানি চাষিরা সেচকাজে ব্যবহার করতে পারছেন না। খালটি শিল্পবর্জ্যে দূষিত হয়ে গেছে। 

মাধবপুর উপজেলার শিবজয়নগর ও হরিতলায় আট বছর আগে পাইওনিয়ার ডেনিম লিমিটেড ও নাহিদ ফাইন টেক্স নামের দুটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এ দুই প্রতিষ্ঠান তাদের কারখানার বর্জ্য সরাসরি খালে ফেলছে। এতে ওই এলাকার মাধবপুরের পাঁচটি, লাখাই উপজেলার দুটি হাওরসহ সাতটি হাওরের কৃষিজমি চাষ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে চলতি বোরো মৌসুমে স্থানীয় চাষিরা সেচকাজে এ পানি ব্যবহার করতে পারছেন না। পাশাপাশি খাল–বিল ও নদে এ দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে। যে কারণে ফসলের মাঠে ফসল হচ্ছে না, খাল–বিলে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। দুর্গন্ধের জন্য বাড়িঘরে থাকা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে এলাকাবাসীর। লোকজন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট ও চর্মরোগে ভুগছেন অনেকে। সব ধরনের জীবন-জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। 

শিবজয়নগর গ্রামের চাষি সিরাজ আলী বলেন, ‘আমরা এলাকাবাসী রাজখালের সেচসুবিধার ওপর নির্ভর করেই চাষাবাদ করি। কিন্তু কয়েক বছর ধরে শিল্পবর্জ্যের দূষণে খাল-বিলের পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।’ তিনি দূষণের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ওই এলাকায় কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য হাওরে, খালে ফেলায় এ পানি পিয়াইম, সাকু চাইল, ধর্মমণ্ডল, লক্ষ্মীপুর, সাইওয়াক, সুবিদপুর, দৌলতপুর, ফানদাউক, মুড়াকরিসহ ২০ থেকে ২৫টি গ্রামের লাখো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ফসলের মাঠে ফসল হচ্ছে না, খাল-বিলে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। দুর্গন্ধের জন্য বাড়িঘরে থাকা চরম কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

বাপা হবিগঞ্জের সম্পাদক ও খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার তোফাজ্জল সোহেল বলেন, ওই এলাকায় আট বছর আগে পাইওনিয়ার ডেনিম লিমিটেড ও নাহিদ ফাইন টেক্স কারখানা গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য খালে ফেলায় খালের পানি এখন কালো হয়ে আছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। চরম পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। তিনি বলেন, ‘শুরুতেই আমরা কলকারখানার “উৎসে বর্জ্য পরিশোধন”ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ এবং সুষ্ঠু শিল্পায়নে প্রয়োজনীয় ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তা মানছে না। এসব প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত বর্জ্য পরিশোধন না করে কারখানার বাইরে ফেলায় পানি দূষিত হচ্ছে।’ 

পাইওনিয়ার ডেনিম লিমিটেডের মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা ফারুক হোসেইন বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব বর্জ্য শোধনাগার আছে। আমরা এ পানি পরিশোধিত করেই খালে ফেলি। আমাদের পানি দূষিত হলে আমরা এ পানিতেই মাছ চাষ করতে পারতাম না।’ তাঁর দাবি, আশপাশের অন্যান্য কারখানার বর্জ্যে খালের পানি দূষিত হচ্ছে। 

নাহিদ ফাইন টেক্স লিমিটেডের এজিএম মফিজ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা আশপাশের খালে কোনো বর্জ্য ফেলি না। একই এলাকায় আরও শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে। তাদের কারণে হয়তো এ খালের পানি কালো ও দূষিত হচ্ছে।’