রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্ধকোটি টাকার যন্ত্র চুরির মামলার এজাহারে ‘অসংগতি’
বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের কেমিক্যাল হাউস এলাকার কয়লা পরীক্ষার ২ নম্বর ল্যাব থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা মূল্যের কয়লার দাহ্য ক্ষমতা পরীক্ষার যন্ত্র চুরি হওয়ার ঘটনায় করা মামলার এজাহারে অসংগতি পাওয়া গেছে।
জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, চুরির ঘটনায় করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট নয়। যেমন এজাহারের শুরুতে বলা হয়েছে, ‘টেস্টিং ল্যাব-২–এর দরজার নিচ দিয়ে পানি বের হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ল্যাব খুলে পরিষ্কারের পর দেখা যায় যে যন্ত্রটি চুরি করিয়া নিয়া গিয়াছে।’ একই এজাহারের শেষ অংশে লেখা হয়েছে, ‘ক্লিনার তাঁর জেনারেল ডিউটি শুরু করে ল্যাব পরিষ্কার করতে গিয়ে মেশিনটি যথাস্থানে নেই বলে দেখতে পান।’ দুটি বিষয় এক নয়। তিনি আরও বলেন, ‘বাদী যেভাবে খুশি এজাহার দিতে পারেন। বিষয়টি আমরা তদন্ত করব।’
১৫ জুন যন্ত্রটি চুরি হয়। পরদিন রামপাল থানায় একটি মামলা করেন মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্রকল্পের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও নিরাপত্তা) মো. অলিউল্লাহ। মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের দাপ্তরিক নাম মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্রজেক্ট। মামলায় দাপ্তরিক নাম ব্যবহার করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘১৫ জানুয়ারি আনুমানিক সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে রামপাল উপজেলার সাপমারী কাটাখালী এলাকার (রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র) মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্রজেক্টের কেমিক্যাল হাউস এরিয়ার কয়লা টেস্টিং ল্যাব-২–এর দরজার নিচ দিয়ে পানি বের হচ্ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরিষ্কার করার জন্য ল্যাবের ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, কয়লার মান পরীক্ষার যন্ত্রটি ল্যাব থেকে অজ্ঞাতনামা চোর/চোরেরা চুরি করে নিয়ে গেছে। যন্ত্রটির নাম বম্ব ক্যালরিমিটার। আনুমানিক মূল্য ৪৭ লাখ টাকা।’
পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৪ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টার দিকে প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আবদুল মালেক ল্যাব-২ বন্ধ করার সময় টেস্টিং যন্ত্রটি যথাস্থানে ছিল। এরপর তিনি ল্যাব-২–এর চাবি পার্শ্ববর্তী ল্যাব-১–এর মুসা পারভেজকে দিয়ে সেটি ল্যাব টেকনিশিয়ান মো. সাদ্দাম হোসেন ও তানভীর রহমানকে দিতে বলেন। পরে মুসা চাবিটি ওই দুজনের কাছে হস্তান্তর করেন।
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, ওই দিন রাত ১০টায় পালা পরিবর্তন হলে ল্যাব-১–এ দায়িত্ব পালন শুরু করেন মো. জাকারিয়া আল রাজী এবং মাসুম বিল্লাহ। পরদিন সকাল সাতটা পর্যন্ত দায়িত্বরত ছিলেন তাঁরা। সকাল সাতটা থেকে পরবর্তী পালা শুরু হলে দায়িত্ব শুরু হয় মো. সাদ্দাম হোসেন ও মো. মাসুম বিল্লাহর। এরপর সাধারণ দায়িত্ব (জেনারেল ডিউটি) শুরু হলে ক্লিনার আবদুল নোমান ল্যাব-২ পরিষ্কার করতে যান। এ সময় তিনি দেখেন, মেশিনটি নেই।
ডলার-সংকটে আমদানি ব্যাহত হওয়ায় কয়লার অভাবে টানা ১৫ দিন উৎপাদন বন্ধ রয়েছে এ তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের। এর মাঝে কেন্দ্রটির সুরক্ষিত এলাকায় পাহারা থাকার মধ্যেই ল্যাবের ‘তালবদ্ধ ঘর’ থেকে যন্ত্রটি চুরির ঘটনা ঘটল।
মামলার তদন্ত তদারকির দায়িত্বে থাকা পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে তারে কী করে তাড়াবেন আপনি? সেখানে ল্যাবের ভেতরে কয়লা পরীক্ষা করা হয়। পাশেই কর্মকর্তা কাজ করেন। সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা প্রহরী থাকে। ঘর তালাবদ্ধ থাকে। সেখান থেকে বড় প্রিন্টার আকৃতির কয়লা পরীক্ষা করার একটি যন্ত্র হঠাৎ নাই হয়ে গেল। বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন বিবেচনা করে তদন্তকাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এই যন্ত্রে কয়লার মান পরীক্ষা করা হয়। এটি না থাকলে কাদের লাভ? কেন্দ্রের কেউ জড়িত আছে কি–না, এসব বিষয় ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
বিষয়টি নিয়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেন, এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রায়ই চুরির খবর আসে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় তামার তার, লোহার পাইপসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী উদ্ধারও হয়েছে। তবে এই যে দামি যন্ত্রটি চুরি হলো, এটা কিন্তু সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসবে না। সেখানে বিক্রিও করা যাবে না। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, যে ল্যাব থেকে যন্ত্রটি চুরি হয়েছে, তার ভেতরে কোনো নিরাপত্তা ক্যামেরা ছিল না। তবে বাইরে বিভিন্ন স্থানে একাধিক ক্যামেরা রয়েছে। ক্যামেরার ফুটেজগুলো চাওয়া হয়েছে। তবে ১৪ দিনেও ফুটেজগুলো তাঁদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি।
এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রামপাল থানার সহকারী পরিদর্শক (এসআই) লিটন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন শিফট অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। সব বিষয় যাচাই–বাছাই করা হচ্ছে। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা তদন্ত তদারকি করছেন।’
পুলিশ ও প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ মাসে র্যাব ও আনসার ব্যাটালিয়নের অভিযানে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চুরি যাওয়া কোটি টাকার মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে। আটকও হয়েছেন ৫৪ জন।
রামপাল থানার ওসি মোহাম্মদ সামছুদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি তদন্তাধীন আছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত ও যন্ত্রটি উদ্ধারে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, গত দুই বছরে রামপাল থানায় এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে চুরিসংক্রান্ত ৩০টি মামলার অভিযোগপত্র হয়েছে। আরও কয়েকটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।