সিলেটে আওয়ামী লীগের ২৫ নেতার বাড়ি-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, থানায় আগুন

সিলেট কোতোয়ালি মডেল থানায় আগুন দেওয়া হয়। থানার সামনে জ্বলছে পুলিশ ভ্যানছবি: প্রথম আলো

শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর গতকাল সোমবার মধ্যরাত পর্যন্ত নগরের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী অঙ্গসংগঠনের অন্তত ২৫ জন শীর্ষ পর্যায়ের নেতার বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব হামলায় কতজন হতাহত হয়েছেন, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাসায় হামলার পাশাপাশি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সিলেট পুলিশ সুপারের কার্যালয়; সিলেট কোতোয়ালি মডেল থানা; বন্দরবাজার, সোবহানীঘাট ও লামাবাজার পুলিশ ফাঁড়ি। এ ছাড়া সিলেট জেলা পরিষদ এবং নগর ভবনেও হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়। এর বাইরে সিলেটের পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় ও কেন্দ্রীয় কারাগারে ভাঙচুরের চেষ্টা হয়েছিল বলে দুটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিন দেখা গেছে, নগরের বন্দরবাজার এলাকায় জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের ভবনের ভেতর থেকে ধোঁয়া উড়ছে। ভবনের সামনে বেশ কয়েকটি পোড়া গাড়ি পড়ে আছে। লোকজন এখানে ভিড় করে ধ্বংসস্তূপের ছবি তুলছেন। ভাঙচুরের শিকার নগর ভবনের সামনে পড়ে থাকা কাচ পরিষ্কার করছেন সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। অন্যদিকে বন্দরবাজার, সোবহানীঘাট ও লামাবাজার পুলিশ ফাঁড়িও পুড়ে গেছে।

একাধিক পুলিশ সদস্য জানিয়েছেন, জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের কোনো জরুরি কাগজপত্রই আর অবশিষ্ট নেই। আসবাবসহ সব জরুরি কাগজ পুড়ে ছাই হয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছে বন্দরবাজার, সোবহানীঘাট ও লামাবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ক্ষেত্রেও। আজ মঙ্গলবার কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তবে পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও ফাঁড়িগুলো পুনরায় সংস্কার করে চালু করা হলেও জরুরি কাগজপত্রের অভাবে মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হবে।

এদিকে প্রত্যক্ষদর্শী ও আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা-কর্মী বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর প্রচারিত হওয়ার পরপরই পৃথক মিছিল নিয়ে একদল মানুষ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের গুরুত্বপূর্ণ ও পরিচিত নেতাদের বাসায় গিয়ে হামলা চালায়। হামলা-ভাঙচুর হয়েছে সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী, দুজন সংসদ সদস্য, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র ও একাধিক কাউন্সিলরের বাসভবনেও।

সিলেটের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে
ছবি: প্রথম আলো

ভাঙচুরের পাশাপাশি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রবাসী ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ (সদর ও নগর) আসনের সংসদ সদস্য এ কে আবদুল মোমেন, সুনামগঞ্জ-১ (তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা ও মধ্যনগর) আসনের সংসদ সদস্য রনজিত চন্দ্র সরকার এবং সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বাসভবন। শাপলাবাগ এলাকায় শফিকুরের, ধোপাদিঘিরপার এলাকায় মোমেনের, গোপালটিলা এলাকায় রণজিতের এবং পাঠানটুলা এলাকায় আনোয়ারুজ্জামানের বাসা অবস্থিত।

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা জানান, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিলেট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন খানের বাসায়ও হামলা চালানো হয়। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের তিনবারের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের শ্বশুরবাড়িও আক্রমণের শিকার হয়েছে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের মধ্যে ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদের বাসায় হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। এ ছাড়া গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম এবং ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রুহেল আহমদের কার্যালয়। সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক মো. মখলিছুর রহমান কামরানের কার্যালয়েও হামলা করা হয়। আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে পরিচিত ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেক উদ্দিন তাজের বাসা ভাঙচুরের পাশাপাশি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িও ভস্মীভূত হয়।

এ ছাড়া দলনিরপেক্ষ হওয়া সত্ত্বেও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রেজওয়ান আহমদের বাসায়ও ভাঙচুরের পাশাপাশি আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। রেজওয়ানের বড় ভাই সিলেটের প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও জাসদ সিলেটের সভাপতি লোকমান আহমদ। নগরের আম্বরখানা বড়বাজার এলাকায় তাঁদের যৌথ পরিবারের বসবাস।

সিলেটের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে
ছবি: প্রথম আলো

হামলা-ভাঙচুরের শিকার হয়েছে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ ও সহসভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ, সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ, সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি কিশওয়ার জাহান, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আফতাব হোসেন খান এবং সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক গোলাম সোবহান চৌধুরীর বাসভবনও।
বাসাবাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ঘরানার নেতাদের একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও হামলা চালানো হয়। এর মধ্যে নগরের চৌহাট্টা এলাকায় অবস্থিত সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক মো. মবশ্বির আলী এবং সিলেট জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমদের ফার্মেসি ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে আগুন দিয়ে সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সিলেট নগরের বড় ফার্মেসিগুলোর মধ্যে এ দুটো ফার্মেসিও ছিল।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কার্যনির্বাহী সদস্য ও সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাহি উদ্দিন আহমদ সেলিমের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মাহাতেও ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। সিলেটে সবচেয়ে বড় কয়েকটি কাপড় ও প্রসাধনসামগ্রীর দোকানের মধ্যে এটি একটি। নগরের নয়াসড়ক এলাকায় প্রতিষ্ঠানটি অবস্থিত। এ ছাড়া নগরের ধোপাদিঘিরপার এলাকার হোটেল অনুরাগসহ নগরের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়।

এদিকে মঙ্গলবার পৌনে একটার দিকে সিলেট এমসি কলেজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল এবং গতকাল সোমবার রাতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং চেতনা  ৭১ ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়।

এদিকে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় নির্মাণাধীন ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের নির্মাণসামগ্রী লুটপাটের পাশাপাশি দুটি এক্সেভেটর ও একটা চেইন ডোজারসহ বিভিন্ন উপকরণ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভোলাগঞ্জ পর্যটন দেয়াল, ভোলগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়িসহ ১০ নম্বর ঘাটের বিভিন্ন দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়েছে।

হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. জাকির হোসের খানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘থানা, ফাঁড়িতে হামলা চালানো হয়েছে। পুলিশও অরক্ষিত অবস্থায় আছে। এ অবস্থায় অন্যান্য স্থানে নিরাপত্তা দেওয়া সংগত কারণেই পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ, সরকারি যেসব স্থাপনা ভাঙচুরের পাশাপাশি অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে, সেসব তো রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এ সম্পদ তো জনগণেরই। তাই জনগণকেই এসব সম্পদ রক্ষা করতে হবে।’