প্রতি শুক্রবার গাউসিয়া হোটেলের মেহমান গরিব-দুঃখীরা

দুস্থ মানুষজনকে প্রতি শুক্রবার এভাবে আপ্যায়ন করে পটিয়ার রেলস্টেশন এলাকায় অবস্থিত গাউসিয়া হোটেল কর্তৃপক্ষ। ১৫ নভেম্বর দুপুরে তোলাছবি: প্রথম আলো

কারও এক পা নেই, লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন। কেউ এতিম, কেউ স্বামী পরিত্যক্ত। কারও সন্তান থেকেও নেই। কারও নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন অনেকেই। প্রতি শুক্রবার চট্টগ্রামের পটিয়ার গাউসিয়া হোটেলের সামনে এমন মানুষজনের ভিড় দেখা যায়। সপ্তাহের এক দিন তাঁরা এই হোটেলে ‘মেহমানের’ সম্মান পান। খেতে পারেন পেট ভরে।

পটিয়া পৌরসভার রেলস্টেশনের পাশে গাউসিয়া হোটেলের অবস্থান। মালিক তিন ভাই—নুরুল আলম, আবুল কালাম ও আবুল কাসেম। তাঁদের উদ্যোগেই দুই বছর ধরে চলছে এই আয়োজন। একসময় দিনমজুরি করতেন হোটেলটির প্রতিষ্ঠাতা তিন ভাইয়ের বাবা। তাঁরা নিজেরাও কষ্ট করেছেন অনেক। থাকতে হয়েছে না খেয়ে। এখন সচ্ছলতা এলেও আগের কষ্টের কথা ভোলেননি তাঁরা। তাই মানুষের খাবারের কষ্ট দূর করতেই এমন সেবামূলক কার্যক্রম।

প্রতি শুক্রবার অন্তত দেড় শ থেকে দুই শ দুস্থ মানুষ বিনা মূল্যে খান গাউসিয়া হোটেলে। খাবারের মেনুতে কোনো সপ্তাহে থাকে মাছ-আলু, সবজি, ডাল; আবার কখনো ডিম, সবজি, ডাল, মুরগির মাংস কিংবা গরুর মাংস। মাঝেমধ্যে দেওয়া হয় বিরিয়ানি। খাবারের পদে যা–ই থাকুক, পরিবেশন আর আতিথেয়তায় থাকে আন্তরিকতা।

১৫ নভেম্বর দুপুরে পটিয়া রেলস্টেশন এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, গাউসিয়া হোটেলের সামনের রাস্তায় চলছে ‘মেহমানদারির’ আয়োজন। জুমার নামাজের সময় ঘনিয়ে এসেছে। নামাজ শেষ হলেই খেতে আসবেন লোকজন। তাই পাতা হচ্ছিল টেবিল। নিচে মেঝেতেও বিছানো হয়েছে পাটি। নামাজ শেষ হতে না হতেই একে একে আসতে থাকেন হোটেলের মেহমানরা। কেউ চেয়ার-টেবিলে, কেউ পাকা মেঝেতে সারিবদ্ধভাবে বসে পড়েন।

হোটেল মালিকদের একজন নুরুল আলম নিজে বড় ডেকচি থেকে প্লেটে প্লেটে ভাত–তরকারি বেড়ে দিচ্ছিলেন। তাঁর বড় ছেলে অনার্সে পড়ুয়া ছাত্র রবিউল হোসেন সেসব প্লেট নিয়ে রাখছেন অতিথিদের সামনে। খাওয়া শেষ হলে প্রত্যেকের হাতে গুঁজে দেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা করে।

ওই দিন বেলা ৩টা পর্যন্ত ১৫০ জনের মতো নারী-পুরুষ দুপুরের খাবার খেয়ে গেছেন। কারও কারও সঙ্গে শিশুও ছিল। ৩টার পরও লোকজন খেতে আসছিলেন। কিন্তু বিরক্তির চিহ্ন দেখা গেল না হোটেল মালিক ও কর্মচারীদের মধ্যে।

ওই আয়োজনে খেতে এসেছিলেন পটিয়ার হাইদগাঁও গ্রামের শুক্কুনী (৬৫) নামের এক ভিক্ষুক। কেমন লাগছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই হোটেলে তিনি অনেক দিন ধরে প্রতি শুক্রবার এসে দুপুরে বিনা মূল্যে ভাত খেয়ে যান। অনেক ভালো খাবার দেন তাঁরা। পেট ভরে খান। আল্লাহ তাঁদের রহমত দান করবেন।

টেবিলে বসে খাচ্ছিলেন কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার মোহাম্মদ লোকমান (৫০) নামের এক ব্যক্তি। কাজের সন্ধানে তিনি পটিয়ায় এসেছেন বলে জানালেন। খবর পেয়ে তিনি এখানে এক বেলা ভালো খাবার খেতে এসেছেন। খেয়ে খুবই তৃপ্তি পেয়েছেন বলে জানান।

খেতে আসা লোকজনকে ‘মেহমান’ বলে সম্বোধন করেন হোটেলের মালিক ও কর্মচারীরা। খাওয়ানো হয় যত্নের সঙ্গে। ১৫ নভেম্বর দুপুরে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

ভিড় কমে আসায় কথা বলার ফুরসত পান হোটেলের মালিক নুরুল আলম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক কষ্টে দিন গেছে। এই হোটেল দেওয়ার আগে বাবা দিনমজুরি করতেন। কখনো কাজ মিলত না। কখনো গ্রাম থেকে নিজের মাথায় করে শহরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবজিও বিক্রি করেছেন। তাই আমরা কষ্ট দেখেছি। এমন দিনও গেছে ঘরে, চাল ছিল না। না খেয়ে ঘুমিয়েছি। মা মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে কাজ করতেন। বুঝতে পারি, না খেয়ে থাকার কষ্টটা কেমন। তাই এমন আয়োজনের কথা মাথায় আসে।’

নুরুল আলম নিজেও বাজারে বাজারে গিয়ে পলিথিন, পেয়ারা, আইসক্রিম, পান বিক্রি করেছেন। চাকরি করেছেন চায়ের দোকানে। এসব কাজে সঙ্গী ছিলেন তাঁর ভাই। তিনি বলেন, এমন কঠিন পরিস্থিতির পর স্বল্প পুঁজি দিয়ে একসময় তাঁর বাবা রেলস্টেশন–সংলগ্ন একটি চায়ের দোকান দেন। দোকানটি চালুর পাঁচ বছর পর তাঁর বাবা মারা যান। এরপর তাঁরা তিন ভাই মিলে গাউসিয়া নাম দিয়ে ভাতের হোটেল চালু করেন।

নুরুল আলম বলেন, হতদরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠায় বাবাসহ তিন ভাই মিলে তাঁরা অনেক কষ্ট করেছেন। আজ তাঁদের অভাব নেই। কিন্তু এমন সুখ বাবা দেখে যেতে পারেননি। তাঁর স্মরণেই তাঁরা গরিব-দুঃখীদের খাওয়ান।

গাউসিয়া এখন রীতিমতো ব্যবসা সফল একটি হোটেল। খাবার ভালো হওয়ায় দূরদূরান্ত থেকেও মানুষজন এখানে খেতে আসেন। হোটেলের আরেক মালিক নুরুল আলমের ছোট ভাই আবুল কাসেমের মুখ থেকে শোনা গেল গাউসিয়া হোটেলের সাফল্যের কাহিনি। তিনি বলেন, ‘শুরুতেই আমরা তিন ভাই বাবার সঙ্গে দোকানে বেচা-বিক্রিতে সহযোগিতা করতাম। সবার ভালো ব্যবহার করার কঠোর নির্দেশ ছিল বাবার। সেই সঙ্গে খাবার মানসম্মত রাখা এবং দাম রেখে লাভ কম করার চেষ্টা করতেন তিনি। ফলে ধীরে ধীরে হোটেলে কাস্টমার বাড়তে থাকে। বাড়ে ব্যবসাও। বর্তমানে এই হোটেলে মেজবানি গরুর মাংসসহ নানা পদের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে।’