চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত মির্জাপুর শাহী জামে মসজিদের সামনের দেয়ালে লতাপাতা ও ইসলামি ঐতিহ্যপূর্ণ টেরাকোটা নকশাখচিত মাঝারি আকৃতির তিনটি দরজা। মোগল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত অপূর্ব নিদর্শনের মসজিদটি নির্মাণশৈলী টেরাকোটা ফুল ও লতাপাতার নকশায় পরিপূর্ণ। এসব নকশার একটার সঙ্গে আরেকটার মিল নেই। মসজিদে ব্যবহৃত ইটগুলো রক্তবর্ণ ও অলংকৃত। যা বর্তমান সময়ের ইটের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এভাবেই মির্জাপুর শাহী মসজিদের কারুকাজের বর্ণনা দিচ্ছিলেন মসজিদ পরিচালনা কমিটির সদস্য মির্জা কামরুল ইসলাম। সোমবার দুপুরে মসজিদের সামনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। মির্জাপুর শাহী মসজিদের আদি নির্মাতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া না গেলেও তাঁদের বংশের পূর্ব পুরুষেরা মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন।
দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড় শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামে মির্জাপুর শাহী মসজিদের অবস্থান।
আটোয়ারী উপজেলা শহর থেকে মির্জাপুর গ্রামের দূরত্ব ছয় কিলোমিটার। মির্জাপুর বাজার থেকে পূর্বদিকে রিকশা বা ভ্যানে করে এক কিলোমিটার গেলেই চোখে পড়বে মির্জাপুর শাহী মসজিদটি। স্থাপনাটি দর্শনার্থীদের নজর কাড়ছে যুগ যুগ ধরে। পঞ্চগড় কিংবা তেঁতুলিয়া ঘুরতে এসে মির্জাপুর শাহী মসজিদ দেখে যাননি, এমন পর্যটকের সংখ্যা খুবই কম।
মসজিদটি কত সালে নির্মিত, তা নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য আছে। তবে এটা যে মোগল আমলের স্থাপত্য, তাতে একমত সবাই। কারণ মসজিদটিতে আছে মোগল স্থাপত্যরীতির সুস্পষ্ট ছাপ। মসজিদের শিলালিপি ঘেঁটে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ধারণা করেন, ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে নির্মিত মসজিদের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে এই মসজিদের। তাই ধারণা করা হয়, মির্জাপুর শাহী মসজিদটি ১৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছে।
জাতীয় তথ্য বাতায়ন থেকে জানা যায়, দোস্ত মোহম্মদ নামের এক ব্যক্তি মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষ করেন। মসজিদের নির্মাণ সম্পর্কে পারস্য ভাষায় লিখিত মধ্যবর্তী দরজার উপরিভাগে একটি ফলক আছে। ফলকের ভাষা ও লিপি অনুযায়ী, মোগল সম্রাট শাহ আলমের রাজত্বকালে এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। মসজিদটির দেয়ালের টেরাকোটা ফুল এবং লতাপাতার নকশা খোদাই করা। মসজিদের সম্মুখভাগে আয়তাকার টেরাকোটার নকশার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, একটির সঙ্গে অপরটির কোনো মিল নেই, প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা।
মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট, প্রস্থ ২৫ ফুট। এক সারিতে তিনটি গম্বুজ। মসজিদের নির্মাণশৈলী ও দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে। মসজিদের গম্বুজের শীর্ষবিন্দু ক্রমহ্রাসমান বেল্টযুক্ত, চার কোণে রয়েছে স্তরযুক্ত ও নকশাখচিত বেল্ট করা চারটি সুচিকন মিনার। সামনের দেয়ালের মধ্য দরজার দুই পাশে মধ্য গম্বুজের সঙ্গে সমন্বয় রেখে নির্মিত হয়েছে আরও দুটি ক্ষুদ্র মিনার। এই মিনারের দেয়াল সংযুক্ত অংশ বর্গাকার। একই রকমের দুটি ক্ষুদ্রাকৃতির মিনার রয়েছে পশ্চিম দেয়ালেও। মসজিদের তিনটি দরজার উপরিভাগের মাঝামাঝি স্থানে বাইরের দিকে উভয় পাশে ঢালু তোরণ আকৃতির একটি অতিরিক্ত স্ফীত অংশ সংযুক্ত হওয়ায় অলংকরণ বিন্যাসে সৃষ্টি হয়েছে নতুনত্ব।
মসজিদের মূল ভবনের সামনে আছে একটি আয়তাকার পাকা অঙ্গন। অঙ্গনের উপরিভাগ উন্মুক্ত। বাইরে একটি সুদৃশ্য পাকা তোরণ। তোরণটির নির্মাণ কৌশলও অপূর্ব। এতে আছে খিলান করা অন্তঃপ্রবিষ্ট দরজা, উভয় পাশে খাঁজ করা স্তম্ভ, ঢাল ও অর্ধ বৃত্তাকার, নাতিদীর্ঘ একটি গম্বুজ। মসজিদের বাইরে উত্তর-পূর্ব কোনায় রয়েছে প্রাচীন কূপ।
মির্জাপুর শাহী মসজিদের আদি নির্মাতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে জনশ্রুতি ও মির্জা বংশীয় উত্তরসূরিদের ভাষ্য মতে, ফুল মোহাম্মদ নামে একজন মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু করেন। পরে ফুল মোহাম্মদের ভাই দোস্ত মোহাম্মদ সম্ভবত এর নির্মাণকাজ শেষ করেন। এক সময় প্রবল ভূমিকম্পে মসজিদটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রায় ২০০ বছর আগে মুলুকউদ্দীন বা মালেকউদ্দীন মসজিদের মেরামত ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করেন। এ জন্য তিনি হুগলির মসজিদের ইমামের মাধ্যমে ইরান থেকে কারিগর এনেছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির সদস্য মির্জা কামরুল ইসলাম বলেন, মসজিদটি সরকারিভাবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দেখভালের দায়িত্ব নিলেও মূলত ২১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির মাধ্যমে এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মসজিদের সম্পদ হিসেবে প্রায় ৪০ বিঘা আবাদি জমি ও বড় আকারের দুটি পুকুর আছে। এসব জমি ও পুকুর ইজারা দিয়ে সেখানে থেকে বার্ষিক যে আয় হয়, তা দিয়েই মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিনের বেতনসহ বিভিন্ন খরচ বহন করা হয়। তিনি আরও বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় প্রতিদিনই পর্যটকেরা এই মসজিদ দেখতে আসেন। অনেকেই এর ইতিহাস জানতে চান। তাঁদের সেই ইতিহাস জানানোর চেষ্টা করেন।
মির্জাপুর শাহী মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মির্জা আহম্মদ শরীফ বলেন, এক সময় মসজিদটির একটি গম্বুজসহ বিভিন্ন জায়গায় সমস্যা দেখা দিয়েছিল। নব্বই দশকে মির্জাপুর এলাকার সন্তান সাবেক স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজ বেঁচে থাকতে কয়েক দফায় মসজিদটি সংস্কারের কাজ করেছিলেন। সে সময়ই প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে মসজিদটি হস্তান্তর করা হয়। তবে বিভাগটির তেমন তদারকি নেই। এখন মসজিদ কমিটির মাধ্যমেই দেখভাল করা হয়। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মাধ্যমে ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী এই মসজিদের সংস্কার ও তদারকি জরুরি হয়ে পড়েছে।