‘এখন লিখে কী করবেন, আমার বাবারে তো আর ফিরাইয়া দিতে পারবেন না’
বরিশাল নগরের গোরাচাঁদ দাশ রোডের শত বছরের পুরোনো ‘মাহমুদালয়ে’ ভুতুড়ে নীরবতা। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই বাড়িতে কেউ আছেন। শনিবার রাতে মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই পুরোনো বাড়িটা চোখে পড়ল। দরজা খোলা, ভেতরে আলো জ্বলছে।
অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বসতে দিলেন। একটু পরেই নিস্তব্ধতা ভেঙে কান্নার শব্দ ভেসে এল। পাশের কক্ষ থেকে বিলাপ করতে করতে বেরিয়ে এলেন পারভীন সুলতানা।
১৯ জুলাই বিকেলে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে রাজধানীর বারিধারা এলাকায় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া আবদুল্লাহ আল আবিরের (২৪) মা তিনি। আবির বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতেন। ২০ জুলাই সকালে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
প্রতিবেদকের পরিচয় জেনে কাঁদতে কাঁদতে পারভীন সুলতানা বলছিলেন, ‘এখন এসব লিখে কী করবেন। আমার বাবারে তো আর ফিরাইয়া দিতে পারবেন না।’ একপর্যায়ে ‘আমার আবির, আমার আবির’ বলতে বলতে বুক চাপড়াতে থাকেন।
মায়ের নাড়িছেঁড়া ধন আবির এখন পরিবারের কাছে স্মৃতি। তাঁর স্মৃতির আবির ছড়িয়ে আছে পুরো ঘরময়। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে নির্বাক বাবা মিজানুর রহমান। বড় বোন মারিয়া ইসলাম মৌরি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না ভাইকে বাঁচানোর জন্য ১৪ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর লড়াইয়ের কথা। চোখ মুছতে মুছতে মৌরি বলেন, ‘১২ ব্যাগ রক্ত দিলাম। ভাইটাকে বাঁচাতে রাতভর কত যুদ্ধ করলাম। তবু বাঁচাতে পারলাম না...।’
নগরের গোরাচাঁদ দাশ রোডের ‘মাহমুদালয়’ নামের বাড়িটা বেশ পুরোনো। আবিরের বাবার মামার বাড়ি। এখানেই ছোট থেকে বড় হয়েছেন আবির। তাঁদের গ্রামের বাড়ি বাবুগঞ্জ উপজেলার ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামে। মহল্লায় আবিরের পরিচিতি ছিল শান্ত, সৌম্য এক তরুণ। সবার সঙ্গে প্রাণখুলে মিশতেন। ছিলেন পরোপকারী। ২০১৬ সালে বরিশাল উদয়ন স্কুল থেকে এসএসসি পাসের পর ভর্তি হন রাজধানীর মিরপুর বাংলা কলেজে। সেখান থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর বরিশালে ফিরে সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। খেলাপাগল আবিরের পড়াশোনায় খুব একটা মন ছিল না। গত বছর বড় বোন মারিয়া ভাইকে ঢাকায় নিয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির ব্যবস্থা করেন।
মারিয়া জানান, ১৯ জুলাই ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ চলছিল। চারদিকে গুলি, সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে কাঁপছিল। দুপুরের খাবার খেতে আবির বারিধারায় তাঁদের বাসায় যান। খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে আবার কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে তাঁর এক বন্ধু ফোন করে জানান, আবির অসুস্থ হয়ে গুলশান মা ও শিশু হাসপাতালে ভর্তি আছেন। পরে তিনি হাসপাতালে জানতে পারেন, তাঁকে এমজেড হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, আবিরকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে। সেখানে গিয়ে জরুরি বিভাগে ভাইকে খুঁজে পান।
মারিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘তখনো আবির কথা বলছিল। টেনশন না করতে বলছিল। তাঁর পেট বরাবর একটি গুলি লেগে কিডনিতে লাগে। সেখান থেকে রক্ত ঝরছিল। ড্রেসিং করে বেডে নেওয়ার পর রক্তক্ষরণ বাড়তে থাকে। রাত ১২টায় অস্ত্রোপচার শুরু হয়। চলে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। একটি কিডনি অপসারণ করা হয়। কিন্তু রক্তক্ষরণ থামছিল না। একে একে ১২ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়। অস্ত্রোপচার শেষে আইসিইউতে রাখা হয়। পরদিন সকাল সাড়ে আটটার দিকে মারা যায়।’ একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন মারিয়া।
ছোটবেলা থেকেই খেলাপাগল আবিরের হকি, ক্রিকেট ছিল প্রিয়। বসার ঘরে শোকেসে সাজানো তাঁর খেলাধুলায় পুরস্কার পাওয়া মেডেল, ক্রেস্ট, বিভিন্ন তৈজসপত্র দেখাচ্ছিলেন মা পারভীন সুলতানা। সেসব বের করে ছেলের স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলেন।
পারভীন সুলতানা বলেন, ‘আমার বাবায় কখনো গ্রামে যাইতে চাইত না। অনেক বুঝাইছি। গ্রামের বাড়িতে একটা বিল্ডিং তুলছি। খালি কইত আমি বরিশাল ছাইড়া গ্রামে যামু না। হেই গ্রামেই আমার বাপেরে ঘুম পড়াইয়্যা থুইয়্যা আইছি।’
গোরাচাঁদ দাশ রোডের ভুতুড়ে বাড়িটা তখন কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে। মন খারাপ করা পরিবেশ চারপাশে। বাড়ির সামনে ঈশ্বরবসু লেন ধরে এগোতে এগোতে সেসব আর্তনাদ-আহাজারি কানে বাজছিল। আকাশে উঁকি দেওয়া প্রকাণ্ড চাঁদটাকে তখন বেদনায় ভারাক্রান্ত লাগছিল।