‘বাবার তো কোনো অপরাধ ছিল না, তাকে কেন গুলি করে মারা হলো’
১৮ জুলাই আশুরা উপলক্ষে রোজা রেখে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন তাজুল ইসলাম। বিকেলে রাজধানীর উত্তরার একটি মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আশপাশে তখন চলছিল সংঘর্ষ। নামাজ শেষে মসজিদের বাইরে এসে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিলেন তাজুল। তখনই একটি বুলেট এসে লাগে তাজুল ইসলামের বুকে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তাজুল ইসলামের মৃত্যুর এই বিবরণ পাওয়া গেছে। তিনি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার উত্তর শীলমুড়ি ইউনিয়নের গামারোয়া গ্রামের মৃত আইয়ুব আলীর ছেলে। তিনি স্ত্রী, দুই কন্যা ও এক ছেলে নিয়ে ঢাকার পূর্বাচল এলাকার কাঞ্চন ব্রিজসংলগ্ন উলুখোলা এলাকায় বসবাস করতেন। উত্তরা আজমপুর এলাকায় রেন্ট-এ কারের ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। একসময় গাড়ি চালিয়ে তিনি সংসারের খরচ মেটাতেন। বার্ধক্যের কারণে একজন চালক রেখেছেন।
গতকাল রোববার সকালে বরুড়া উপজেলার গামারোয়া গ্রামে গিয়ে তাজুল ইসলামের বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের কাউকে পাওয়া যায়নি। জরুরি কাজে তাঁর স্ত্রী-সন্তান ঢাকায় গেছেন। ভাইয়ের মৃত্যুতে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখা গেল তাজুল ইসলামের জেঠাতো ভাই দেলোয়ার হোসেন মিয়াজিকে। তিনি জানান, ১৮ জুলাই তাঁর ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। যখন মারা যান, তখন তিনি রোজা মুখে ছিলেন। পরদিন শুক্রবার বেলা আড়াইটায় জানাজার নামাজ শেষে দাফন হয়।
ঘটনার দিন ঢাকা শহরের গোলাগুলির খবরে তাজুলকে রাস্তায় বের হতে নিষেধ করেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। তবে তিনি তা শোনেননি বলে জানান ছেলে সিয়াম। তিনি বলেন, বাবা দুপুরে জানিয়েছিলেন উত্তরার একটি মসজিদের ভেতর আছেন। বিকেলে ইফতার নিয়ে বাসায় আসবেন। বিকেলে সংঘর্ষের সময় মসজিদ থেকে রাস্তায় উঁকি দিতেই গুলিবিদ্ধ হন। মুঠোফোনে ফোনে খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে বাবার গুলিবিদ্ধ মরদেহ দেখতে পান। সেদিনের পরিস্থিতির কথা বর্ণনা করে সিয়াম বলেন, ‘তখন হাসপাতালে রক্তাক্ত অনেক মানুষের চিৎকার আর আহাজারিতে দিশাহারা হয়ে পড়ি। এ বয়সে এত রক্ত কখনো দেখিনি।’
সিয়াম বলেন, ‘আমার বাবার তো কোনো অপরাধ ছিল না, তিনি কোটা আন্দোলনের পক্ষে–বিপক্ষে ছিলেন না। তাঁকে কেন গুলি করে মারা হলো। এখন কীভাবে চলবে আমাদের সংসারের খরচ। সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই। কার কাছে বিচার চাইব? বাবার মৃত্যুর শোকে মা–ও এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’
তাজুল ইসলামের ছোট ভাই রফিকুল ইসলাম জানান, অন্যদের কাছ থেকে জেনেছেন, তাঁর ভাই বাসায় ফিরতে চেয়েছিলেন। তাই রাস্তার পরিস্থিতি দেখতে মসজিদ থেকে বের হন। এ সময় হঠাৎ গুলি এসে বুকে লাগে। তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভাই মারা যাওয়ার কারণে চিকিৎসকেরা মরদেহের ভেতর থেকে আর গুলি বের করেননি। এ অবস্থাতেই গ্রামের বাড়িতে নিয়ে তাঁকে দাফন করা হয়। ভাইয়ের মৃত্যুতে তাঁর সংসারটি অসহায় হয়ে গেল। সরকারি কোনো সহায়তা না পেলে পরিবারটিকে রাস্তায় বসতে হবে।’