শীতলক্ষ্যায় মাছ নেই, জেলেদের দুর্দিন
নারায়ণগঞ্জের একরামপুর জেলেপাড়ায় আগে ১২৫টি পরিবার ছিল। এখন শীতলক্ষ্যায় মাছ না থাকায় ওই পাড়ায় মাত্র দুটি পরিবার আছে।
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার একরামপুর জেলেপাড়ার প্রবীণ জেলে হরিদাস বর্মণ (৬৪)। প্রায় ৫০ বছর ধরে মাছ শিকার করছেন। শৈশবে বাবা–চাচাদের সঙ্গে দল বেঁধে শীতলক্ষ্যা নদীতে মাছ শিকারে যেতেন। কৈশোর–যৌবনেও বাড়ির পাশের শীতলক্ষ্যাই ছিল তাঁর আয়ের একমাত্র উৎস। তবে বার্ধক্যে এসে মাছের খোঁজে দূরের ধলেশ্বরী কিংবা মেঘনা নদীতে যেতে হচ্ছে তাঁকে।
নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে শীতলক্ষ্যা পার হয়ে সোজা পূর্ব দিকে গেলেই বন্দর উপজেলার একরামপুর জেলেপাড়া। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে কথা হয় হরিদাসসহ পাড়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে। তাঁরা জানান, নামে জেলেপাড়া হলেও পাড়ার ১২৫টি পরিবারের মধ্যে কেবল ২টি পরিবার এখন জেলে পেশার সঙ্গে যুক্ত। প্রায় ৩০ বছর ধরে ক্রমাগত দূষণের ফলে শীতলক্ষ্যা নদী এখন প্রায় মাছশূন্য। আর তাতেই ধীরে ধীরে পেশা বদল করেছেন পাড়ার জেলেরা। যেসব জেলে বাধ্য হয়ে পুরোনো পেশা ধরে রেখেছেন, তাঁদেরও যেতে হচ্ছে দূরের নদীতে।
আজ বিশ্ব নদী দিবস। নদী রক্ষায় মানুষকে সচেতন করার জন্য দিবসটি পালন করা হয়। এ উপলক্ষে নদীর খোঁজখবর নিতে হরিদাস বর্মণের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে পাওয়া গেল শীতলক্ষ্যায় দূষণের এই ভয়াবহ চিত্র। তিনি বলেন, ‘শীতলক্ষ্যা নদীর এই অংশে মাছ তো দূরের কথা, কোনো পোকাও পাওয়া যায় না। অথচ আমাগো বাপ–দাদারা শত শত বছর ধইরা এই নদীতে মাছ ধরছে। ৩০ বছর আগেও আমাগো পাড়ার ৬০–৭০টা নৌকা এই শীতলক্ষ্যায় মাছ ধরত। নদীতে মাছ না পাইয়া সবাই এখন অন্য কাজ করে। কেউ মাছ কিন্না বেঁচে, রিকশা-ভ্যান চালায়, কেউ ডকইয়ার্ড, গার্মেন্টসে কাজ করে। আমরা দুই ঘর জাউল্লা নিজের নদী ছাইড়া অন্যের নদীতে যাই মাছ ধরতে।’
নদীর অন্য এলাকায় গিয়েও মাছ পাচ্ছেন না জেলেরা। হরিদাস জানান, প্রতি নৌকায় ৮ থেকে ১০ জন মানুষ কাজ করেন তাঁরা। দূরে যেতে হলে তেল, বরফের সঙ্গে খাবার খরচও বেড়ে যায়। বাড়তি খরচ ও পরিশ্রমের পর যতটুকু মাছ জোটে, তাতে অভাব ঘোচে না। অথচ ২৫ বছর আগেও শীতলক্ষ্যায় বিপুল পরিমাণে মাছ ধরা পড়ত।
হরিদাস জানালেন, ‘মোহনা থেইক্কা (নারায়ণগঞ্জের কলাগাছিয়া) কাঁচপুর পর্যন্ত আমরা মাছ ধরতাম। শীতলক্ষ্যার চিংড়ি, আইর ও রিটা মাছের খ্যাতি আছিল। এসব মাছ বিক্রি হইত ৩ নম্বর মাছ ঘাটে।’
হরিদাসের পাশাপাশি আলাপে যুক্ত হন অনিল বর্মণ, মাধব বর্মণ ও উত্তম বর্মণের মতো পাড়ার প্রবীণ বাসিন্দারাও। একসময়ের এই জেলেরা গত ত্রিশ বছরে ধীরে ধীরে পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন। নদী ও জেলেজীবনের এই সংকটের জন্য শীতলক্ষ্যা নদীর দূষণকেই দায়ী করেন তাঁরা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, পানিতে জীববৈচিত্র্য টিকে থাকার জন্য ন্যূনতম ৪ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম অক্সিজেন থাকার কথা। কিন্তু শীতলক্ষ্যার পানিতে শূন্য দশমিক ৫ মিলিগ্রাম অক্সিজেন রয়েছে।
বাংলাদেশের নদী ও পানিবিষয়ক নাগরিক সংগঠন রিভারাইন পিপলস-এর প্রতিষ্ঠাতা শেখ রোকন প্রথম আলোকে বলেন, শীতলক্ষ্যার দুই ধারে যেসব কারখানা ও ডাইং ফ্যাক্টরি আছে, সেগুলো থেকে রাসায়নিক বর্জ্য নদীতে ফেলা হয়। এটা নদীদূষণের একটি বড় কারণ।
বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক জানান, দূষণ বন্ধে একসময় বিকেএমইএ বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে মিলে একটি সমন্বিত ইটিপি স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিল। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে শেষ পর্যন্ত সেই উদ্যোগটি বাস্তবায়িত হয়নি।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, নদী রক্ষায় তাঁরা নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন। দূষণ বন্ধে বেশ কিছু কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।