স্ত্রীকে হত্যার দায়ে স্বামীর আমৃত্যু কারাদণ্ড, লাশ সাগরে ফেলে দণ্ডিত হোটেলমালিকেরা
পটুয়াখালীর কুয়াকাটার একটি হোটেলে নিয়ে স্ত্রীকে গলাটিপে হত্যার দায়ে স্বামীর আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন নরসিংদীর একটি আদালত। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের সহযোগী হিসেবে এক আসামিকে যাবজ্জীবন এবং লাশ গুমের অপরাধে তিনজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে নরসিংদীর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ শামীমা পারভীনের আদালত এই রায় দেন।
সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন হত্যাকাণ্ডের শিকার মার্জিয়া কান্তার স্বামী কুড়িগ্রামের রৌমারীর চরবামনের চর এলাকার শহিদুল ইসলাম ওরফে সাগর, তাঁর মামাতো ভাই মামুন মিয়া, কুয়াকাটার আল মদিনা হোটেলের দুই মালিক দেলোয়ার হোসেন ও আনোয়ার হোসেন এবং হোটেলটির ব্যবস্থাপক আমির হোসেন। কারাদণ্ডের পাশাপাশি শহিদুল ইসলামকে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং দেলোয়ার হোসেন, আনোয়ার হোসেন ও আমির হোসেনকে ১০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে।
আদালতের সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি) এম এ এন অলিউল্লাহ বলেন, উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেরিয়েই পলাতক শহিদুল ইসলাম ও মামুন মিয়া। তবে রায় ঘোষণার সময় অন্য তিন আসামি দেলোয়ার হোসেন, আনোয়ার হোসেন ও আমির হোসেন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। বিজ্ঞ আদালত ১৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এই রায় দিয়েছেন।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মার্জিয়া কান্তার বাবা সোহরাব হোসেন বলেন, ‘এই রায়ে আমরা খুশি নই। আমার মেয়ের সঙ্গে তারা যা করেছে, তাদের ফাঁসি হলে খুশি হতাম।’
আদালত ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, নরসিংদীর বেলাব উপজেলার সোহরাব হোসেনের মেয়ে মার্জিয়া কান্তা সাভারের আশুলিয়ায় একটি বিউটিপারলার চালাতেন। সেখানেই শহিদুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। ২০১৭ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পরই মার্জিয়া কান্তা জানতে পারেন স্বামী শহিদুল একজন প্রতারক, একাধিক বিয়েও করেছেন। পারিবারিক কলহের জেরে একপর্যায়ে মার্জিয়া তাঁকে ছেড়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। এর কিছুদিন পর শহিদুল শ্বশুরবাড়িতে এসে মার্জিয়াকে বুঝিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যান।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণে জানা যায়, ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তাঁরা দুজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে আশুলিয়ার জামগড়া যান। সেখানে থেকে পরদিন যান কুড়িগ্রামে। সেখানেও এক রাত থেকে তাঁরা শরীয়তপুরের একটি আবাসিক হোটেলে উঠেন। সেখানে অবস্থানের সময় শহিদুল তাঁর মামাতো ভাই মামুনকে চট্টগ্রাম থেকে আসতে বলেন। শহিদুল ও মামুন মিলে ওই হোটেলে মার্জিয়াকে হত্যা করার চেষ্টা করলেও সফল হননি। পরে পটুয়াখালী শহরের একটি হোটেলে চলে যান তাঁরা। সেখানেও এক রাত থেকে তাঁরা ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে কুয়াকাটার আল মদিনা হোটেলে উঠেন। ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে শহিদুল ও মামুন মিলে মার্জিয়া কান্তাকে গলাটিপে হত্যার পর লাশ পলিথিনে পেঁচিয়ে বক্সখাটের নিচে লুকিয়ে রেখে পালিয়ে যান।
দুই দিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর দুর্গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে হোটেলের ব্যবস্থাপক আমির হোসেন বক্সখাটের নিচে পলিথিনে প্যাঁচানো লাশ দেখতে পান। তিনি ঘটনাটি হোটেলের দুই মালিক দেলোয়ার হোসেন ও আনোয়ার হোসেনকে জানান। ওই দিন দিবাগত রাতে আড়াইটার দিকে তাঁরা তিনজন মিলে লাশ কুয়াকাটার সমুদ্রে ফেলে দেন।
এদিকে মেয়ের কোনো খোঁজ না পেয়ে ২০১৯ সালে ৩১ জানুয়ারি বেলাব থানায় শহিদুল ইসলামসহ তাঁর পরিবারের আরও চার সদস্যের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন মার্জিয়ার বাবা সোহরাব হোসেন। পরবর্তী সময় মামলার তদন্তের ভার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হাতে দেন আদালত। তদন্তভার পেয়ে পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক মনিরুজ্জামান তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ওই হোটেল থেকে মার্জিয়া কান্তার পোশাকসহ নানা আলামত উদ্ধার করেন। যার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। পরবর্তীকালে ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তিনি।
এই মামলায় আসামি পক্ষের আইনজীবী ছিলেন মো. শাহজাহান মিয়া, আবু তালেব ও মাইনুল হোসেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন এপিপি এম এ এন অলিউল্লাহ ও মো. আসাদুজ্জামান।