ছাত্রলীগের সংঘর্ষে আহত ফারুক চোখে আলো পাচ্ছেন না, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় মা

ঢাকায় জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওমর ফারুক
ছবি: সংগৃহীত

‘আমার ছেলেকে উচ্চশিক্ষা ও সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলাম। বাড়ি থেকে ভালো অবস্থায় পাঠিয়ে এখন আমার ছেলের একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেল। ডাক্তার বলেছে, আমার ছেলে একটি চোখে আর দেখতে পারবে না। তার যে একটি অঙ্গ নষ্ট হয়ে গেল, এখন তার কী হবে?’

কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন মেরিনা আক্তার। তিনি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত শিক্ষার্থী ওমর ফারুকের মা। ওমর ফারুক বর্তমানে রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

আজ রোববার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন মেরিনা আক্তার। তিনি বলেন, গতকাল শনিবার ওমর ফারুকের চোখের অস্ত্রোপচার হয়েছে। আজ সকালে ব্যান্ডেজ খোলা হয়। এরপর ডান চোখটিতে আর আলো পাচ্ছেন না ওমর ফারুক।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ওমর ফারুক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুস সামাদ আজাদ হলের ৩০৯ নম্বর কক্ষে থাকেন। তাঁর আহত হওয়ার খবর পেয়ে গতকাল সকালে ঢাকায় গিয়েছেন মেরিনা আক্তার ও তাঁর স্বামী আলমগীর হোসেন।

আরও পড়ুন

মেরিন আক্তার বলেন, ছেলে রাজনীতি করেন কি না, সেটি তিনি জানেন না। নিয়মিত কথা হলেও ছেলের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে কথা হতো না। স্বপ্ন ছিল, ছেলে পড়ালেখার পর সংসারের হাল ধরবেন। এখন তিনি ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, তিনি নিজেও এখন অন্ধকার দেখছেন। ছেলের উন্নত চিকিৎসার পাশাপাশি ভালো ভবিষ্যৎ চান তিনি। এর বাইরে তাঁর আর কিছু চাওয়ার নেই।

ওমর ফারুকের বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার আমিরাবাড়ী ইউনিয়নের গুজিয়াম গ্রামে। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়। ছোট ভাই স্থানীয় একটি হাফিজিয়া মাদ্রাসায় পড়ছে। বাবা আলমগীর হোসেন আগে ব্যবসা করলেও এখন বাড়িতে অবসর সময় পার করছেন। পরিবারের আশা ছিল, বড় ছেলে পড়ালেখা শেষ করে সংসারের হাল ধরবেন।

যেভাবে আহত হন ফারুক

গত শুক্রবার সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে চোখে আঘাত পেয়েছিলেন ওমর ফারুক। ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আশিকুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মো. এমাদুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন পক্ষের সঙ্গে সহসভাপতি শরিফ হোসেন, সাব্বির মোল্লা; যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রান্ত ইসলাম; সাংগঠনিক সম্পাদক আরমান হোসেন, মোশাররফ হোসেন ও আকাশ ভূঁইয়ার নেতৃত্বাধীন পক্ষের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের ১০ জন আহত হয়েছিলেন।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওমর ফারুকের সঙ্গে মুঠোফোনে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। ফারুকের ভাষ্য অনুযায়ী, ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও তেমন সক্রিয় ছিলেন না তিনি। হলে থাকার জন্য যতটুকু সম্পৃক্ততা প্রয়োজন, ততটুকু রাজনীতি করতেন। বড় ভাইয়েরা মিছিল–মিটিংয়ে নিয়ে যেতেন। এর বাইরে কোনো পদ-পদবি নেই তাঁর।

ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত একজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার সময়ের ছবি। গত শুক্রবার সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

আহত হওয়ার প্রসঙ্গে ওমর ফারুক বলেন, শুক্রবার জুমার পর থেকে ক্যাম্পস উত্তপ্ত ছিল। নামাজ শেষে হলে ফিরে আসার পর ‘বড় ভাইয়েরা’ বলেছিলেন নিচে নামতে। নিচে নামার পর খাওয়াদাওয়া শেষ করেছিলেন তিনি। প্রথমে তিনি মনে করেছিলেন, কোনো মিছিলে যাওয়ার জন্য ডাকা হয়েছে। তবে একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সে সময় ক্যাম্পাস থেকে তিনি নিজে তিনজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে পাঠান।

ওমর ফারুক বলেন, বেলা তিনটার কাছাকাছি সময় আবদুস সামাদ হলের নিচতলার কলাপসিবল গেট খোলা ছিল। সে সময় তিনি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে সবাইকে গেটের ভেতরে যেতে বলছিলেন। তখন ইটপাটকেল নিক্ষেপ চলছিল। গেটের ভেতরে মাথা ও বাইরে শরীর ছিল। হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই একটি ইট গিয়ে ডান চোখে আঘাত করে। এরপরই তিনি উল্টে পড়ে যান। এরপর কয়েকজন তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে রাতেই তাঁকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে গতকাল তাঁর অস্ত্রোপচার হয়েছে। আজ চিকিৎসকদের সঙ্গে নিজে কথা বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, দেশে যতটুকু চিকিৎসা সম্ভব, তাঁরা করেছেন।

আরও পড়ুন

ওমর ফারুকের দ্বিতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা চলছে। কিন্তু সংঘর্ষে আহত হয়ে হাসপাতালে থাকায় তিনি অংশ নিতে পারছেন না। ওমর ফারুক বলেন, ১৯ জানুয়ারি দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন তিনি একটি চোখে দেখতে পান না। এমন অবস্থায় কীভাবে কী হবে, বুঝতে পারছেন না। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে উন্নত চিকিৎসার জন্য সহায়তা চান, যাতে দেশের বাইরে হলেও চিকিৎসা নিয়ে চোখের আলো ফিরে পান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ওমর ফারুকের চিকিৎসার তথ্য নিয়মিত নিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তবে সকালে চোখের ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে বলে শুনেছেন। এ নিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে যতটুকু করণীয়, তার সবকিছুই করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন