ত্বকী হত্যার ১০ বছর
‘বিচারের জন্য কত বছর অপেক্ষায় থাকতে হবে’
২০১৩ সালের ৬ মার্চ বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন ত্বকী। দুই দিন পর শীতলক্ষ্যা থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়।
‘আমার নিরপরাধ ছেলেটাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। হত্যাকারীরা চিহ্নিত হওয়ার পরেও ১০ বছরে বিচার হলো না। এটি কেমন দেশ? প্রধানমন্ত্রী বললেন, তিনি সব জানেন, বিচার করবেন—তারপরও হলো না কেন? বিচারের জন্য কত বছর অপেক্ষায় থাকতে হবে?’ আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর মা।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ নগরের শায়েস্তা খান রোডের বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন ত্বকী। দুই দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী শাখাখাল থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ১০ বছর পূর্ণ হলেও এখনো বিচার শুরু হয়নি। অথচ ওই বছরের ১২ নভেম্বর আজমেরী ওসমানের সহযোগী সুলতান শওকত আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিলেন, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ত্বকীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়।
‘আমরা শুরু থেকে ত্বকী হত্যার বিচার চেয়ে আসছি। এখনো আমরা এই হত্যার বিচার চাই। যারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’আনোয়ার হোসেন, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি
মামলার তদন্তকারী সংস্থা র্যাব-১১ ত্বকী হত্যার এক বছরেই খুনিদের শনাক্ত ও হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি করে সংবাদ সম্মেলনে জানায়, অভিযোগপত্র প্রস্তুত, শিগগিরই আদালতে দাখিল করা হবে। কিন্তু ৯ বছরেও সেটি আদালতে জমা দেওয়া হয়নি। মামলাটি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল আদালতে বিচারাধীন। আগামী ১৩ এপ্রিল শুনানির তারিখ রয়েছে।
মামলার তদন্তকারী সংস্থা র্যাব-১১ ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটির তদন্ত চলমান। তদন্ত শেষ হলেই দ্রুত আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ মামলায় ৬১টি ধার্য তারিখে আদালতে শুনানি হয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসা আসামিদের গ্রেপ্তার ও দ্রুত অভিযোগপত্র দাখিলে বহুবার আমরা আদালতে বলেছি। আদালত মামলার তদন্তকারী সংস্থাকে তাগিদ দিলেও তারা কোনো সাড়া দেয়নি।’
খুনিদের শনাক্ত ও হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন এবং অভিযোগপত্র প্রস্তুতের বিষয়টি জানিয়ে ২০১৪ সালের ৫ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে মামলার র্যাব-১১। র্যাব সদর দপ্তরে ওই সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, অপহরণের পর আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ১১ জন ত্বকীকে হত্যা করেন।
‘দেশে আইনের শাসন নেই বলেই ত্বকী হত্যার বিচার আটকে রাখা হয়েছে। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানাচ্ছি।’শংকর রায়, জোটের সভাপতি ভবানী
র্যাব তখন জানায়, ২০১১ সালে সিটি নির্বাচনে মেয়র আইভীর পক্ষে অবস্থান, সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও তাঁর অনুগতদের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জবাসীকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা এবং ভূমি দখলের প্রতিবাদে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বির প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন বিরোধীরা। তাঁকে শায়েস্তা করতেই ত্বকীকে হত্যা করা হয়। তবে ওসমান পরিবার ত্বকী হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।
জেলায় ২২টি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার মধ্যে ত্বকী হত্যা মামলা তালিকার ১১ নম্বরে। চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভা থেকে নিয়মিত মনিটরিং ও তদারকি করা হলেও ত্বকী হত্যার বিচারে কোনো অগ্রগতি নেই। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি মনিরুজ্জামান বুলবুল প্রথম আলোকে বলেন, ত্বকী হত্যা মামলায় র্যাব এখনো অভিযোগপত্র জমা দেয়নি। দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে মাসিক সভা থেকে তাদেরকে তাগিদ দেওয়া হয়।
ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জ নাগরিক আন্দোলনের নেতা। ওসমান পরিবারের অপকর্মের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জবাসীর স্বার্থের পক্ষে সোচ্চার তিনি। এ কারণে ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক জেলার সভাপতি ধীমান সাহা জুয়েল। ত্বকী হত্যার পর থেকে বিচারের দাবিতে প্রতি মাসের ৮ তারিখে ধারাবাহিকভাবে মোমশিখা প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করে আসছে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট।
ত্বকী হত্যা বিচারহীনতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ উল্লেখ করে জোটের সভাপতি ভবানী শংকর রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন নেই বলেই ত্বকী হত্যার বিচার আটকে রাখা হয়েছে। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানাচ্ছি।’
ত্বকী হত্যার বিচারের দাবি জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারাও। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকে ত্বকী হত্যার বিচার চেয়ে আসছি। এখনো আমরা এই হত্যার বিচার চাই। যারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ত্বকী হত্যার বিচার না হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে দেশের ২৬ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি প্রদান করেছেন।
নিহত ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি বলেন, ‘অপরাধী শনাক্ত হওয়ার পরও ত্বকী হত্যার বিচার বন্ধ করে রাখা সরকারের বিচারহীনতা ও দুর্বৃত্ততোষণের রাজনীতিরই বহিঃপ্রকাশ। ওসমান পরিবারের ঘাতকদের এভাবে রক্ষা করে সরকার দেশের গোটা বিচারব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে।’