গাজীপুরের টঙ্গী
ডেসটিনির ২৯ বিঘা জমিতে ট্রাকস্ট্যান্ড
২০১৩ সালে আদালতের নির্দেশে ডেসটিনির টঙ্গীর এই জায়গা ক্রোক করা হয়। জায়গাটির দেখভালের দায়িত্ব পায় গাজীপুর মহানগর পুলিশ।
ভরাটের মাধ্যমে জায়গাটি পুরোপুরি দখল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ডেসটিনির বিনিয়োগকারীরা।
জায়গাটিতে বালু ফেলা হয়েছে প্রায় ২ হাজার ট্রাক। মাঝে সপ্তাহখানেক ভরাটের কাজ বন্ধ ছিল। আবার শুরু হয়েছে।
গাজীপুরের টঙ্গীর সোনালী সড়ক এলাকায় বিশাল সীমানাপ্রাচীরে ঘেরা প্রায় ২৯ বিঘা জমির মূল ফটকে ঝুলছে আদালতের নির্দেশনাসংবলিত একটি সাইনবোর্ড। লেখা ‘বিজ্ঞ মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ, ঢাকা-এর আদেশক্রমে অত্র সম্পত্তির রিসিভার কমিশনার, গাজীপুর মহানগর পুলিশ’। ২৪ ঘণ্টা পাহারায় আছেন পুলিশের কয়েকজন সদস্য। কিন্তু এর মাঝেই ভেঙে ফেলা হয়েছে সীমানাপ্রাচীর। বালু-মাটি ফেলে চলছে দখলের কাজ। এর সঙ্গে জড়িত পুলিশ নিজেই।
বায়নাসূত্রে জমিটির মালিক বিতর্কিত বহুস্তর বিপণন প্রতিষ্ঠান (এমএলএম) ডেসটিনির বনায়ন কার্যক্রম অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেড’। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় ২০১৩ সালে আদালতের নির্দেশে ডেসটিনির টঙ্গীর এই জায়গা ক্রোক করা হয়। জায়গাটির দেখভালের দায়িত্ব পায় গাজীপুর মহানগর পুলিশ।
ক্রোক করা জায়গা আদালতের অনুমতি ছাড়া এভাবে দখল বা ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন দুদকের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।
ডেসটিনি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা যায়, অস্থায়ী ট্রাকস্ট্যান্ড নির্মাণের জন্য বালু ও মাটি ফেলে জায়গাটি ভরাট করছে গাজীপুর জেলা ট্রাক কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন। অনুমতি দেওয়ার পাশাপাশি সার্বিক তত্ত্বাবধান করছে টঙ্গী পূর্ব থানা-পুলিশ। এরই মধ্যে দখলে নেওয়া হয়েছে ১০ থেকে ১২ বিঘা জমি।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দখল করছি না। পুলিশের অনুমতিক্রমে বিশ্ব ইজতেমা সামনে রেখে অস্থায়ীভাবে ব্যবহার করছি।’
টঙ্গী পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘টঙ্গীতে কোনো ট্রাকস্ট্যান্ড নেই। তাঁদের নিজেদেরও কোনো ডাম্পিং স্টেশন নেই। তাই উভয় দিক চিন্তা করেই জায়গাটি ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ট্রাকশ্রমিকদের আগ্রহের ভিত্তিতেই আমরা অনুমতি দিয়েছি।’
টঙ্গীতে কোনো ট্রাকস্ট্যান্ড নেই। তাঁদের নিজেদেরও কোনো ডাম্পিং স্টেশন নেই। তাই উভয় দিক চিন্তা করেই জায়গাটি ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ট্রাকশ্রমিকদের আগ্রহের ভিত্তিতেই আমরা অনুমতি দিয়েছি।
সরকারিভাবে ক্রোক করা জায়গা আদালতের অনুমতি ছাড়া দখল বা ব্যবহারের সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন দুদকের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম। তিনি বলেন, রিসিভার (পুলিশ) শুধু জায়গাটির দেখভাল বা রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবেন। নিজে ব্যবহার অথবা কাউকে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদি ব্যবহার একেবারেই জরুরি হয়ে পড়ে, তবে সেটা অবশ্যই আদালতের অনুমতি নিয়েই করতে হবে।
গত রোববার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা জায়গাটির ভেতরে আধা পাকা ঘরে একটি পরিত্যক্ত গুদাম। বাকি জায়গা ফাঁকা। উঁচুনিচু। এর মাঝেই সোনালী সড়কের পাশে (দক্ষিণ পাশে) ভেঙে ফেলা হয়েছে সীমানাপ্রাচীরের একাংশ। সেখানে বালু ফেলে সমান করা হয়েছে ১০ থেকে ১২ বিঘা জমি। রাখা হয়েছে ৮ থেকে ১০টি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান।
এই শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জায়গাটিতে বালু ফেলার কাজ চলছে প্রায় এক মাস ধরে। প্রথমে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে ভরাটের কাজ তদারক করেন। পরবর্তী সময়ে আদালতের নির্দেশনার বিষয়টি সামনে এলে পুলিশ কিছুটা আড়ালে চলে যায়। এরপর থেকে সংগঠনের লোকজন নিজেরাই দায়িত্ব নিয়ে ভরাটের কাজ করছেন।
মো. সুজন মোল্লাহ নামের এক শ্রমিক বলেন, জায়গাটিতে প্রায় দুই হাজার ট্রাক বালু ফেলা হয়েছে। মাঝে সপ্তাহখানেক ভরাটের কাজ বন্ধ ছিল। তবে এখন আবার কাজ শুরু হয়েছে। প্রতিদিন রাতেই ট্রাকে বালু আসছে।
ভরাটের মাধ্যমে জায়গাটি পুরোপুরি দখল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ডেসটিনির বিনিয়োগকারীরা। তাঁরা বলছেন, দুদকের মামলায় ডেসটিনির চেয়ারম্যান ও অন্য কর্মকর্তারা জেলে থাকলেও জায়গাটির ওপর নির্ভর করছে অনেক বিনিয়োগকারীর ভবিষ্যৎ। যাঁরা একসময় ডেসটিনিতে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁরা আদালতের রায় অনুযায়ী এই জায়গা থেকে ক্ষতিপূরণ পাবেন, এমনটাই আশা তাঁদের। কিন্তু এভাবে জায়গাটি দখলের পাঁয়তারায় শঙ্কিত তাঁরা।
মো. সাইফুল ইসলাম নামের এক বিনিয়োগকারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা বাংলাদেশে ডেসটিনির প্রায় ১২ লাখ বিনিয়োগকারী রয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকে অংশীদার ডেসটিনির ক্রোক করা জমির। আমরা সবাই অপেক্ষা করছি আদালতের নির্দেশনার। কিন্তু এর মাঝে কোনোভাবে সেই জমি দখল হয়ে যাওয়াটা খুবই দুঃখজনক।’
পুলিশ-মেয়রের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য
জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানের ট্রাকস্ট্যান্ড (চেরাগআলী) অস্থায়ী জায়গায়। সেখানে যত্রতত্র গাড়ি রাখা হলে সড়কে প্রচুর যানজটের সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি টঙ্গীর বাইপাস সড়কগুলো দখল করে ট্রাক রাখায় যানজটে সারাক্ষণ মানুষের ভোগান্তি হয়। সেদিক বিবেচনায় এবং বিষয়টি সিটি করপোরেশনের মেয়রকে জানালে তাঁরা আপাতত জায়গাটি ব্যবহার করতে বলেন। স্থায়ী ট্রাকস্ট্যান্ড নির্মাণের কাজ চলছে। সেটি হয়ে গেলেই জায়গাটি ছেড়ে দেওয়া হবে। সিটি করপোরেশনও বালু-মাটি দিয়ে সহযোগিতা করছে।
আদালতের অনুমতি নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, জায়গাটি মাত্র তিন-চার মাসের জন্য ব্যবহার করা হবে। এটা স্থায়ী স্ট্যান্ড নয়।
তবে জায়গাটি ব্যবহারে সহযোগিতার কথা অস্বীকার করেছেন সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আদালতকে অমান্য করে এ ধরনের অনুমতি বা সহযোগিতার প্রশ্নই আসে না। আমরা এ ব্যাপারে কিছু জানি না। যদি কেউ বলে থাকে, তবে মিথ্যা বলেছে।’