বাগেরহাটে ভৈরব নদকে ‘সবাই গলা টিপে ধরেছে’

বাজারের ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়েছে নদে। ধীরে ধীরে ভরাটের পর দখল করা হয়। বাগেরহাট শহরের প্রধান কাঁচাবাজার–সংলগ্ন ভৈরব নদেছবি: প্রথম আলো

‘রক্ষার বদলে বছরের পর বছর নদী মারতেই যত আয়োজন। কখনো ব্যবসায়ী, কখনো দলনেতা, বাদ যায় না সরকারি দপ্তরও। মুখে নদী রক্ষার কথা বললেও বাস্তবে সবাই নদী-খাল হত্যায়ই ব্যস্ত।’ আক্ষেপ করে বলছিলেন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মী সুব্রত কুমার মুখার্জি।

বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলায় সুব্রত কুমার মুখার্জির বাড়ি। ছোটবেলা গ্রাম থেকে খাল-নদী ধরে জেলা সদর বাগেরহাটে আসতেন তিনি। সেই কথা মনে করে তিনি বলছিলেন, ‘ছোট খালগুলোর অধিকাংশই তো দখল হয়ে গেছে। স্বাভাবিক প্রবাহ নেই অনেক নদীতে। বহু বছর ধরে প্রভাবশালীরা এগুলো দখল করে সেখানে মাছ চাষ করে আসছে। শহরের প্রধান নদ ভৈরবকে তো সবাই গলা টিপে ধরেছে। কোথাও ময়লা ফেলে ভরাট করে, কোথাও নানা স্থাপনা নির্মাণ করে, দখলে প্রতিনিয়তই নদীকে ছোট করে ফেলা হচ্ছে।’

সাড়ে সাত বছর আগে বাগেরহাটের ভৈরব-দড়াটানা নদী রক্ষার এক আন্দোলনে সুব্রত মুখার্জির সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন আরিফুল ইসলাম (সজিব)। তিনি বলেন, ‘চোখের সামনে প্রতিদিনই আমাদের নদটা দখল হয়ে যাচ্ছে। শহরের পাশের দুই কিলোমিটারেই কয়েক শ দখলদার নানাভাবে নদী দখল করেছে। কেউ স্থাপনা, কেউ ইট–কাঠ–পাথর, সরকারি থেকে ধর্মীয় স্থাপনা—দখলের এই ঐক্য দেখতে দেখতে আমরা অসহায়। বিভিন্ন সময় দায়িত্বশীলদের জানিয়েও নদীটি রক্ষায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপই নেই। নদী রক্ষায় বাগেরহাটবাসীর শপথ সবাই মিলেই ভাঙছে প্রতিনিয়ত।’

২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল প্রথম আলোয় বাগেরহাট শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ভৈরব ও দড়াটানা নদীর দখল-দূষণ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার মুখে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে প্রশাসন। এরপর স্থায়ীভাবে নদীতীর রক্ষায় বৃক্ষরোপণ ও সামাজিক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ওই সমাবেশ অংশ নিয়ে শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিভিন্ন সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষ অঙ্গীকার করেন নদী রক্ষার। নেন শপথও।

জেটি নির্মাণে দড়াটানা নদী ভরাট করে চলছে কাজ। বাগেরহাট শহরের কেবি ঘাট–সংলগ্ন এলাকায়। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় তোলা
ছবি: প্রথম আলো

সেই শপথের কথা তুলে ধরে আরিফুল ইসলাম বলেন, ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান, সেখান থেকে রাষ্ট্র। ওই শপথ কেউ মানেনি। এই সাড়ে সাত বছরে আমাদের নদী আরও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগত দখলের পাশাপাশি বিভিন্ন দপ্তর নানা নামে স্থাপনা বানাচ্ছে। ডাকবাংলো এলাকায় ভৈরব নদের প্রায় ২৫ ফুট ভেতরে স্থাপনা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভের নামে ওই অবকাঠামোর পর নদীর পশ্চিম পারের বড় একটি এলাকায় চর পড়ে গেছে। সংকুচিত হয়ে পড়েছে প্রবহমান নদী। দড়াটানা-ভৈরব নদের বিভিন্ন স্থানে এমন অসংখ্য স্থাপনা ও দখলের পাশাপাশি প্রতিনিয়তই নতুন নতুন দখল চলছে। এতে পিছিয়ে নেই সরকারি দপ্তরও। প্রায় সাত বছর আগে দড়াটানা নদীর ভদ্রপাড়া খেয়াঘাট পারে নদীর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়। পাশের নদী বাঁকের বড় চরটি দখল করে বালু ফেলে উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে পার্ক। ফলে নদীর এই অংশ হারিয়েছে প্লাবনভূমি।

ওই পার্ক থেকে প্রায় ৩০০ মিটার দক্ষিণে নতুন করে নদীর মধ্যে আরও এক স্থাপনা নির্মাণ করছে এখন মৎস্য বিভাগ। সাসটেইনেবেল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের অধীনে জেটি নির্মাণের নামে নদীর প্রায় ২০ ফুট ভেতর পর্যন্ত পাইলিং করে আটকে দেওয়া হয়েছে এর প্রবাহ। প্রায় তিন মাস আগে বাগেরহাট সদরের কেবি মৎস্য আড়ত–সংলগ্ন দড়াটানা সেতুর উত্তর পাশে এই নির্মাণকাজ শুরু হয়। সেখানে পাইলিং ও বালু দিয়ে ভরাট করার পর বোরিং করে ঢালাই দেওয়া হচ্ছে। এই কাজের জন্য পাশের শহর রক্ষা বাঁধের সড়কের ওপর রাখা হয়েছে বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী।

আরও পড়ুন

দখল–দূষণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে ভৈরব নদ

ভৈরব নদকে কেন্দ্র করে বাগেরহাট শহরের গোড়াপত্তন। তবে শহরের বিকাশ ও বিস্তৃতি যেন নদটির মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রভাবশালীদের দখল, অবৈধ ভবন নির্মাণ, ময়লার ভাগাড়সহ নানা কারণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে নদটি। ক্ষীণ হয়ে গেছে স্রোতোধারা, পলি জমেছে ভরাট তলদেশে।

ভৈরব নদ বাগেরহাট শহরের উত্তর দিক থেকে এসে সুপারিপট্টি খেয়াঘাটের কাছ দিয়ে পূর্ব দিকে চলে গেছে। দক্ষিণে প্রবাহিত এ নদের অংশ দড়াটানা নদী নামে পরিচিত। নদের পশ্চিম তীরে বাগেরহাট শহর ও জেলার প্রধান বাজার। এখান থেকে তীর ধরে গেলে উত্তর-দক্ষিণ দুই দিকেই কয়েকটি ময়লার স্তূপ চোখে পড়ে। একদিকে অবৈধ দোকানঘর, কাঁচাবাজার, ডেকোরেটরের মালামালসহ ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্য ও আসবাব রেখে দখল করে রেখেছে পুরো তীর, অন্যদিকে বাজার থেকে মুনিগঞ্জ পর্যন্ত রয়েছে কাঠ, ইট আর বালু ব্যবসায়ীদের দখলে। সেই সঙ্গে শহরের বিভিন্ন নালা থেকেও বর্জ্য যাচ্ছে নদীতে।

এ ছাড়া বধ্যভূমি, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থান, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, গুদাম তৈরি করা হয়েছে নদীর জায়গা দখল করে। আবার পৌর পার্ক নির্মিত হয়েছে প্লাবনভূমি দখল করে।

শহরের খারদ্বার এলাকার বাসিন্দা মোল্লা হাসিবুর রহমান বলেন, ‘নদী থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে আমাদের গ্রাম। দাদির কাছে গল্প শুনেছি, নৌকা নিয়ে একদম বাড়ির কাছে আসা যেত। এখন তো কোনো খাল নেই। ফলে একটু বৃষ্টি হলে পানি নামতে পারে না। মাসের পর মাস জলাবদ্ধ হয়ে থাকে রাস্তাঘাটসহ ঘরবাড়ি, উঠান।’

বাগেরহাট শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত দড়াটানা নদীর পার দখল করে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে ওই এলাকায় চর জেগেছে। এই চরও এখন বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে
ছবি: প্রথম আলো

স্থাপনা নির্মাণে নিয়ম মানা হচ্ছে না

নিয়ম অনুযায়ী, নদী বা তীরে কোনো ধরনের নির্মাণকাজের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতা হয়েছে। তবে সম্প্রতি শুরু হওয়া মৎস্য বিভাগের জেটি নির্মাণ কাজে তা মানা হয়নি।

পাউবোর বাগেরহাট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মদ আল-বিরুনী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তর থেকে আমাদের কোনো চিঠি দিয়ে অবহিত করা বা অনাপত্তিপত্র চাওয়া হয়নি। অবশ্য চাইলেও আইনগত কারণেই আমরা তা দিতে পারতাম না। যদিও এটি সরকারি প্রকল্পের কাজ, তবে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় এমন যেকোনো কিছুতে সম্মতি দেওয়ার সুযোগ নেই।’

প্রকল্পের কাজ শুরুর পরপরই মৎস্য বিভাগের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তাঁরা দাবি করেন, এই প্রকল্প ঢাকা থেকে পাস হয়েছে। তাঁরা এর সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানেন না। আর এই কাজে নদীর কোনো ক্ষতি হবে না।

তবে কাজ শুরুর কয়েক দিনের মধ্যেই জেলা প্রশাসন তা বন্ধ করে দেয়। নদী রক্ষা করতে ও নদীর মধ্যে স্থাপনা নির্মাণকাজ বন্ধে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং লিখিত চিঠি দেয় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। গত ১৩ জুন ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, চেকপোস্ট তৈরির নামে আইনকে উপেক্ষা করে নদী ভরাট করা হচ্ছে। আগে থেকে বিভিন্নভাবে ভৈরব নদ দখল হচ্ছে। মাঠ পরিদর্শনে দেখা গেছে, তাপস সাহার গুদাম, মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থান, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, পৌর পার্ক, শতাধিক দোকানপাট, কাঠের গোলা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে দখল হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ঐতিহ্যবাহী ভৈরব নদটি মৃত নদে পরিণত হবে।

এমনিতেও দখল, দূষণ আর বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে নদীটিকে প্রায় শেষ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারি দপ্তর, যারা নদী রক্ষা করবে, তারাই যদি দখল করতে থাকে, তাহলে কীভাবে নদী বাঁচবে।
মাহফুজুর রহমান, বেলার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী

এ বিষয়ে বেলার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান বলেন, যেখানে নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে মূল্যায়ন করে নদী সংরক্ষণের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে এ ধরনের কার্যক্রম সরকারের প্রকল্পভিত্তিক কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভৈরব নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হবে। এমনিতেও দখল, দূষণ আর বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে নদীটিকে প্রায় শেষ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারি দপ্তর, যারা নদী রক্ষা করবে, তারাই যদি দখল করতে থাকে, তাহলে কীভাবে নদী বাঁচবে।

বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল বলেন, জেলা প্রশাসন প্রকল্পের কাজ বন্ধ করেনি। তারা কয়ারি (অনুসন্ধান) করেছিল। আগের স্যারকে (ডিসি) বিস্তারিত বলা হয়েছে। ওখানে সার্ভেল্যান্স চেকপোস্টের জন্য পন্টুন হবে। ভাসমান পন্টুন আটকে রাখার জন্য নিচে একটা কাঠামো দরকার; যার কাজ চলছে। প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয় ঢাকা থেকে।

সার্বিক বিষয়ে কথা হয় বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক আহমেদ কামরুল হাসানের সঙ্গে। সদ্য দায়িত্ব নেওয়া এই কর্মকর্তা বলেন, ‘জেলায় যেসব নদী-খাল দখল ও দূষণে হুমকির মুখে রয়েছে, আমরা সে বিষয়ে দ্রুত খোঁজ নেব। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ এ ক্ষেত্রে তথ্য দিয়ে সহায়তার আহ্বানও জানান তিনি।