চিকিৎসার সুযোগ নেই খুলনায়

থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তের রোগ। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের শরীরে রক্তের লোহিত কণিকা পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি হয় না। 

২০০১ সালে চাচাতো বোনকে বিয়ে করেন খুলনা নগরের এক বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. লিয়াকত আলী। ২০০৬ সালে ছেলের বাবা হন। এ পর্যন্ত সবকিছুই ঠিক ছিল। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় ছেলের ছয় মাস বয়সের পর। হঠাৎ ঠান্ডা থেকে নিউমোনিয়া ও পরে শরীর রক্তশূন্য হয়ে যায়। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানতে পারেন ছেলে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত।

এরপর শুরু হয় লিয়াকত আলীর নতুন যুদ্ধ। ছেলের ৬ মাস বয়স থেকে সাড়ে ১০ বছর পর্যন্ত নিয়মিত চিকিৎসা, রক্ত দেওয়া, রক্ত জোগাড় করা, আনুষঙ্গিক চিকিৎসা করতে গিয়ে অনেক কষ্ট করেছেন তিনি। কষ্টের পাশাপাশি পড়েছেন আর্থিক সংকটেও। ছেলের জন্য সবকিছু করার পরও শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারেননি।

লিয়াকত আলীর দুর্ভোগের এখানেই শেষ নয়। বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত নন, এমন নিশ্চিত হয়ে দ্বিতীয় সন্তানের (মেয়ে) বাবা হন। কিন্তু তৃতীয় সন্তান (মেয়ে) জন্মের দুই মাসের মধ্যে তার শরীরে থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে। ওই সন্তানের বয়স এখন সাড়ে তিন বছর, আবার সেই সন্তানকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন লিয়াকত আলী।

শুরু থেকেই খুলনা মেডিকেল কলেজ ও কলেজ হাসপাতালে হেমাটোলজি নামের কোনো বিভাগ নেই। এ কারণে এত দিন ওই সংক্রান্ত কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক খুলনায় পদায়ন করা হয়নি।
মেহেদী নেওয়াজ, খুলনা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ও খুলনা বিএমএর সাধারণ সম্পাদক চিকিৎসক

লিয়াকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে এমন কোনো কাজ নেই, যা করিনি। ওই সন্তানের রক্তের গ্রুপ ছিল বি নেগেটিভ। প্রতি মাসে কমপক্ষে একবার রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হতো। ওই রক্ত জোগাড় করতে হিমশিম খেয়ে যেতাম।’

আট মাস বয়সেই থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে আনিশা রহমানের। বর্তমানে ওর বয়স সাড়ে আট বছরের মতো। ঢাকায় থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনে রক্ত ও আনুষঙ্গিক চিকিৎসা করিয়ে নিয়ে আসেন মা–বাবা। আনিশার বাবা আওছাফুর রহমান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় আরেকটি সন্তান নিয়েছিলাম, কিন্তু সেটাও থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। এখন আর কোনো কুল খুঁজে পাচ্ছি না। দুই মেয়েরই চিকিৎসা চলছে। কিন্তু কত দিন এভাবে চলবে জানি না।’  

লিয়াকত আলী ও আওছাফুরের মতো এমন অভিজ্ঞতা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত খুলনার অনেক শিশুর বাবা–মায়ের।

তাঁদের মধ্যে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত চার শিশুর মা–বাবার সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের মতে, কোনো শিশু থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত মানে ওই পরিবারের অভিভাবকদের নিশ্চিত মহাবিপদের মধ্যে পড়া। নিজের সন্তানকে নিজের চোখের সামনে মৃত্যু দেখা। সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা।’

‘প্রথম সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে এমন কোনো কাজ নেই, যা করিনি। ওই সন্তানের রক্তের গ্রুপ ছিল বি নেগেটিভ। প্রতি মাসে কমপক্ষে একবার রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হতো। ওই রক্ত জোগাড় করতে হিমশিম খেয়ে যেতাম।’
লিয়াকত আলী

আজ ৮ মে বিশ্ব থ্যাল্যাসেমিয়া দিবস। এ দিবসে খুলনা বিভাগে থ্যাল্যাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের অবস্থা ও চিকিৎসা পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই বিভাগে কতসংখ্যক থ্যালাসেমিয়া রোগী আছে, এমন কোনো পরিসংখ্যান সিভিল সার্জনের কাযালয় বা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে নেই। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও ওই সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। রক্ত দেওয়া ছাড়া খুলনা বিভাগে এর কোনো চিকিৎসাও নেই। নেই কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও।

খুলনা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ও খুলনা বিএমএর সাধারণ সম্পাদক চিকিৎসক মেহেদী নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, শুরু থেকেই খুলনা মেডিকেল কলেজ ও কলেজ হাসপাতালে হেমাটোলজি নামের কোনো বিভাগ নেই। এ কারণে এত দিন ওই সংক্রান্ত কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক খুলনায় পদায়ন করা হয়নি। আর চিকিৎসক না থাকায় ওই সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থাও খুলনায় নেই। তবে বর্তমানে রক্তবাহিত রোগ যে হারে বাড়ছে, তাতে অন্তত খুলনায় সহকারী বা সহযোগী অধ্যাপক পর্যায়ের একজন রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ (হেমাটোলজিস্ট) নিয়োগ দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

যন্ত্রটি নষ্ট হওয়ার পর এখন আর থ্যালাসেমিয়া রোগীদের রক্তের উপাদান আলাদা করে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
মো. জিল্লুর রহমান, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের সদস্যসচিব চিকিৎসক

নেই ‘ব্লাড সেল সেপারেশন’ যন্ত্র

রক্তের বিভিন্ন উপাদান থেকে লোহিত কণিকা আলাদা করে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের দিতে হয়। খুলনা বিভাগের মধ্যে রক্তের উপাদান আলাদা করার যন্ত্র (ব্লাড সেল সেপারেটর মেশিন) ছিল শুধু খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু সেই যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে গেছে। সর্বশেষ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেটিকে বিকল ঘোষণা করা হয়। এরপর হাসপাতাল থেকে নতুন যন্ত্রের জন্য বারবার চাহিদা দেওয়া হলেও এখনো তা আসেনি।

ওই যন্ত্রটি না থাকায় বিপাকে পড়েছেন থ্যালাসেমিয়া রোগীর স্বজনরা। যেখানে রোগীর শরীরে রক্তের নির্দিষ্ট একটি উপাদান দেওয়ার কথা, সেখানে পুরো রক্তই দিতে হচ্ছে। এতে রোগীর শরীরে দেখা দিচ্ছে নানা জটিলতা। অনেকে প্রতি মাসে রোগী নিয়ে ছুটছেন ঢাকায়।

চিকিৎসকেরা জানান, ‘ব্লাড সেল সেপারেটর’ নামের ওই যন্ত্র দিয়ে রক্তের লোহিত কণিকা, অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেট ও প্লাজমা আলাদা করা যায়। রক্তদাতার কাছ থেকে যে পরিমাণ রক্ত সংগ্রহ করা হয়, তার পুরোটা অধিকাংশ সময় রোগীর লাগে না। কিন্তু উপাদান আলাদা করার যন্ত্রটি নষ্ট থাকায়  অনেক সময় পুরো রক্ত দিতে হচ্ছে রোগীকে। এতে একদিকে যেমন রক্তের অপচয় হচ্ছে, আবার অনেক সময় রোগীরা নতুন জটিলতায় পড়ছেন।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের সদস্যসচিব চিকিৎসক মো. জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যন্ত্রটি নষ্ট হওয়ার পর এখন আর থ্যালাসেমিয়া রোগীদের রক্তের উপাদান আলাদা করে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অভিভাবকেরা বাইরে থেকে সেটি করিয়ে নিচ্ছেন অথবা পুরো রক্তই এক সঙ্গে দিচ্ছেন। খুলনা বিভাগের মধ্যে সরকারিভাবে আর কোনো হাসপাতালে এ ধরনের যন্ত্র নেই।