লালন তিরোধান দিবসে সাধু-ভক্তদের ঢল নেমেছে ছেঁউড়িয়ায়
৬০ বছরের রুশিয়া ফকিরানী। আসন নিয়েছেন লালন আখড়াবাড়ির ভেতরে। পরনে হালকা বেগুনি পাড়ের ধবধবে সাদা শাড়ি। রুশিয়া জানান, এক বছর আগে শাড়িটি কিনেছেন। মনে বাসনা ছিল, যেদিন সাঁইজির ঘরে যাবেন, সেদিন গিয়ে শাড়িটা পরবেন। মনের বাসনা পূরণ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই যে বুকের ভেতর আত্মা রয়েছে। সেটা একটা পাখি। বুকের খাঁচার ভেতর পাখি ছটফট করছিল। কখন সাঁইজির কাছে যাব। আজ সেই আশা পূরণ হলো।’
করোনাকাল কাটিয়ে দুই বছর পর আজ সোমবার থেকে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় আখড়াবাড়িতে লালন তিরোধান দিবস উপলক্ষে তিন দিনের আয়োজন শুরু হয়েছে। সেখানে লালনভক্ত, অনুসারী ও সাধুদের ঢল নেমেছে।
বেলা তিনটার দিকে কুষ্টিয়া শহর থেকে আখড়াবাড়িতে যাওয়ার পথে এক কিলোমিটার আগেই মানুষের স্রোত দেখা গেল। শত শত মানুষ ছুটছেন আখড়াবাড়ির দিকে। মূল ফটকে পৌঁছাতেই মানুষের স্রোত যেন আর সামনে এগোতে চায় না।
সাধু-ভক্তরা বলছেন, করোনাকাল যেন সবকিছু থমকে দিয়েছিল। সেটা নেই, এ জন্য এবার মানুষের ঢল নেমেছে। সাধুদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এবার তিন-চার দিন আগে থেকেই সাধু-ভক্তরা আখড়াবাড়িতে ভিড় করতে থাকেন। আখড়াবাড়ি প্রাঙ্গণ বাদ্যযন্ত্র ও গানে গানে মুখর হতে থাকে।
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ৫০ থেকে ৬০ জনের একটি দলকে সাঁইজির সমাধির চারপাশ প্রদক্ষিণ করতে দেখা গেল। তারা ‘জয় লালন, জয় লালন’ বলে গানের সুরে ডাকতে থাকেন। কারও হাতে একতারা, আবার কেউ ঢোল বাজাতে থাকেন। কেউ কেউ ফুল ছিটাতে থাকেন।
চুয়াডাঙা শহরে বাগানপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোমেনা ফকিরানীর বয়স ৯৫ বছর। দাঁতগুলো প্রায় সব পড়ে গেছে। ৫০ বছর ধরে সাঁইজির ধামে আসেন জানিয়ে খালি কণ্ঠে একটি গান ধরলেন, ‘দেখ না মন ঝাঁক মারি, এই দুনিয়াদারি...তোমার পিছে পিছে ঘুরছে সমন...কোন দিন হাতে দেবে দড়ি...।’ মোমেনা বললেন, ‘সাঁইজির কাছে না এলে কিছুই ভালো লাগে না। তিনিই আমাকে ডেকে আনেন।’
সন্ধ্যা সাতটায় লালন একাডেমির আয়োজনে মূল মঞ্চে তিন দিনের আয়োজনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফ। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের সভাপতিত্বে সেখানে বিশেষ অতিথিরা বক্তব্য দেন। পরে লালন একাডেমির শিল্পীরা সেখানে লালনের গান পরিবেশ করেন।
তিন দিনব্যাপী আয়োজন চলবে বুধবার মধ্যরাত পর্যন্ত। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে আলোচনা সভা ও লালন সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
মহাপুরুষ ফকির লালন শাহ ১৮৯০ সালের ১ কার্তিক কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ছেঁউড়িয়া গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। এর পর থেকে আখড়াবাড়ি চত্বরে ভক্ত-অনুসারীরা তাঁদের সাঁইজিকে স্মরণ করে আসছেন। পরে লালন একাডেমি এ আয়োজনের দায়িত্ব নেয়।
২০২০ সালের মার্চ মাসে লালন স্মরণোৎসব হয়। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এর পর থেকে আখড়াবাড়ির সব আয়োজন বন্ধ ছিল। দুই বছর পর চলতি বছরের মার্চ মাসে আবার লালন স্মরণোৎসব হয়।