খুলনা নগরের হার্ড মেটাল গ্যালারি এলাকার তরুণ ব্যবসায়ী নোমানুল ইসলাম (৩১)। ২০১২ সালে সাতক্ষীরা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়ার সময় একটি সংগঠন তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিল। সেখানে পরীক্ষার পর নোমানুল জানতে পারেন তাঁর রক্তের গ্রুপ ‘ও নেগেটিভ’। সেখানে তাঁকে বলা হয়, তাঁর গ্রুপের রক্ত দুষ্প্রাপ্য। বিষয়টি জানার পর থেকে তাঁর মধ্যে রক্তদানের আগ্রহ তৈরি হয়।
কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি হয়ে উঠেছেন নিয়মিত রক্তদাতা। এ পর্যন্ত ৩৭ বার রক্ত দিয়েছেন নোমানুল। বর্তমানে একটি সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত আছেন। এর মধ্যে চার-পাঁচজন রক্তগ্রহীতা তাঁর পূর্বপরিচিত। বাকিদের সঙ্গে রক্ত দেওয়ার আগে কখনো পরিচয় ছিল না। সবশেষ ১৫ দিন আগে এক প্রসূতিকে রক্ত দিয়েছেন।
খুলনায় বর্তমানে স্বেচ্ছায় রক্তদান করার প্রবণতা বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করে এখন দ্রুত রক্তদাতা মিলে যাচ্ছে। বিপদে–আপদে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টায় রক্তদানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে নতুন রক্তদাতা। স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে তরুণের সংখ্যাই বেশি। নারীরাও এখন স্বেচ্ছায় রক্তদানে এগিয়ে আসছেন।
এমন বাস্তবতায় আজ শুক্রবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। বিশ্বব্যাপী স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের উৎসাহিত করতে প্রতিবছর দিনটি পালন করা হয়। তবে খুলনা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পক্ষ থেকে কোনো আয়োজন নেই। সংগঠনগুলো নিজেদের মতো করে কিছু আয়োজন করেছে।
নোমানুল ইসলাম বলেন, ‘রক্তের জন্য ফোন এলে কখনো না করি না। ঈদের দিন, রাত একটা-দুইটা, ভোর চারটা বিভিন্ন সময়ে রক্ত দিয়েছি। একবার রক্ত দেওয়ার পর তিন-সাড়ে তিন মাস হয়ে গেলে রক্ত দেওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি থাকে। একবার দেওয়ার পর কখনো মনে হয় না এবার একটু সময় নেব বা এবারটা দেব না। কারণ, মানুষ বিপদে পড়েই রক্ত চায়।’
নোমানুলের মতো নিয়মিত রক্ত দেন, এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সময় খুলনায় স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার বিষয়ে মানুষের মধ্যে অনাগ্রহ ছিল। মানুষেরা সচেতন ছিলেন না। এখন মানুষ আগের চেয়ে বেশি সচেতন হয়েছে। আগ্রহ বাড়ছে। প্রয়োজনে রক্ত পাওয়া যায়। কেউ রক্তের প্রয়োজনে কোনো একটি সংগঠনের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করলে সবাই মিলে সেটার ব্যবস্থা করে দেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কাজটি সহজ করে দিয়েছে।
খুলনায় মাত্র ছয়টি প্রতিষ্ঠানের রক্তপরিসঞ্চালন করার ক্ষমতা রয়েছে। এর মধ্যে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতাল এবং ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট খুলনা জেনারেল হাসপাতালে (সদর) সবচেয়ে বেশিসংখ্যক রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয়। খুলনা মেডিকেলে বছরে গড়ে ৩৪ হাজার ব্যাগ ও সদর হাসপাতালে গড়ে ১১ হাজার থেকে ১৩ হাজার ব্যাগ রক্ত সঞ্চালন করা হয়। সব মিলিয়ে খুলনায় প্রতিবছর ৫০ হাজারের বেশি ব্যাগ রক্ত লাগে। আর এর অর্ধেকের বেশি আসে স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে। বাকিটা দেন রোগীর আত্মীয়স্বজনরা।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব জিল্লুর রহমান বলেন, সংরক্ষিত রক্ত মানুষ নিতে চায় না। ৯০ শতাংশের বেশি রোগী যেকোনোভাবে রক্তদাতা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। রক্তের চাহিদার বেশির ভাগই পূরণ হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবীর মাধ্যমে।
খুলনার রায়েরমহল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কমলেশ চন্দ্র বাছাড় ২৬ বার রক্ত দিয়েছেন। রক্তদানের পাশাপাশি রক্ত জোগাড় করে দেন এবং মানুষকে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহিত করেন। খুলনার অন্যতম বড় রক্তদাতাদের সংগঠন ‘খুলনা ব্লাড ব্যাংকের’ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কমলেশ।
কমলেশ চন্দ্র বাছাড় বলেন, খুলনা ব্লাড ব্যাংক গঠিত হয় ২০১৭ সালের ১৪ জুন। তখন মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম ছিল। রক্ত কেনাবেচাও হতো। এখন রক্তদানে তরুণরা বেশ আগ্রহী। করোনার সময় থেকেই অনেক এলাকায় রক্তদাতা সংগঠন কার্যক্রম শুরু করেছে। হাসপাতালগুলোয় সংগঠনগুলোর নম্বর দেওয়া আছে। শহরের রোগীরা রক্তের প্রয়োজনে স্বজন বা নিজেরা কোনোভাবে ব্যবস্থা করে নেয়। কিন্তু গ্রাম বিশেষ করে উপকূলবর্তী গ্রাম থেকে আসা রোগীরা বেশির ভাগই সেচ্ছাসেবকদের ওপর নির্ভরশীল।
খুলনা ব্লাড ব্যাংক সূত্র জানায়,এ পর্যন্ত সংগঠনের সদস্যরা প্রায় ৩০ হাজার ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করেছে। সংগঠনের উদ্যোগে প্রায় ৮ হাজার জনকে বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করে দেওয়া হয়েছে। বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করা অনেকেই যুক্ত হয়েছেন খুলনা ব্লাড ব্যাংকের সঙ্গে। এ রকম আরও কয়েকটি সংগঠন হলো মানুষের কল্যাণে আমরা, খুলনা ব্লাড গ্রুপ, খুলনা ব্লাড ডোনার ক্লাব, ডুমুরিয়া ব্লাড ব্যাংক, কয়রা ব্লাড ব্যাংক, দাকোপ ব্লাড ব্যাংক, প্রথম আলো বন্ধুসভা-খুলনা, সন্ধানী ডোনার ক্লাব প্রমুখ।
সন্ধানী ডোনার ক্লাবের সাবেক সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক এম এম রহমান (৪৬) কমপক্ষে ৭৩ বার রক্তদান করেছেন। তিনি বলেন, ‘যখন শুরু করেছি, অনেক সময় পকেটে টাকা থাকত না। তবু ধার করা টাকায় রক্ত গ্রহীতার কাছে গিয়েছি। আগে স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা কম ছিল। এখন স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে সংগঠনগুলো অনেকটা ব্যানারভিত্তিক হয়ে গেছে।’
খুলনা ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক কাজী আবু রাশেদ বলেন, এখানে মাসে ৯০০ থেকে ১ হাজার ১০০ ব্যাগ রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয়। শরীরের রক্ত কণিকাগুলোর মধ্যে লোহিত রক্ত কণিকার আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ ১২০ দিন। তাই কেউ যদি রক্তদান না–ও করেন, তাহলে এই লোহিত রক্ত কণিকা ১২০ দিন পর নষ্ট হয়ে শরীরের অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিশে যায়। তাই সুস্থ মানুষের নিয়মিত (১২০ দিনের চক্রে) রক্ত দিলে কোনো ক্ষতি হয় না। বরং রক্তদানে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ে। তবে রক্তদানের ক্ষেত্রে নিরাপদ রক্ত সঞ্চালনের বিষয়টি মনে রাখতে হবে।