ঝড়, বজ্রপাত থেকে রক্ষায় হাওরের বুকে ‘কৃষকছাউনি’
হাওরে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বোরো ধানের খেত। মাঝখানে লাল-সবুজের একটি পাকা ঘর। এটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘কৃষকছাউনি’। প্রখর রোদ, ঝড়-বৃষ্টি ও বজ্রপাতের সময় হাওরের জমিতে কাজে থাকা শ্রমিকদের বিশ্রাম-আশ্রয়স্থল এটি। স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। ঘরটিতে বসার জন্য রয়েছে পাকা বেঞ্চ, নলকূপ।
স্থাপনাটি কেন্দ্র করে সেখানে মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। প্রতিদিন আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ওই জায়গায় বেড়াতে আসেন। অনেকে মুঠোফোনে ছবি, সেলফি তোলেন।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল ইউনিয়নের হাকালুকি হাওরের পূর্ব সিংগুর এলাকায় এ কৃষকছাউনি পড়েছে। পূর্ব সিংগুর নতুন কুঁড়ি ক্লাবের উদ্যোগে প্রায় চার মাস আগে স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়। গত শনিবার বিকেলে উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ জসিম উদ্দিন আনুষ্ঠানিকভাবে ফিতা কেটে এটি উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে সেখানে ইফতার অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, কৃষকছাউনিটি চমৎকার লেগেছে। ঝড়-বৃষ্টির সময় বজ্রপাতে মাঝেমধ্যে হাকালুকি হাওরে কৃষকদের প্রাণহানি ঘটে। কৃষকছাউনি হাওরের অন্যান্য এলাকার লোকজনের কাছে অনুকরণীয় হতে পারে। বজ্রপাত থেকে রক্ষায় কৃষকছাউনির আশপাশে, রাস্তায় তালগাছ লাগানো যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, পূর্ব সিংগুর গ্রামের ভেতর দিয়ে চওড়া একটি কাঁচা রাস্তা হাকালুকি হাওরের দিকে গেছে। দুই পাশে বোরো ধানের খেত। কোনো কোনো খেতের ধানে পাকা রং ধরেছে। আশপাশে কোনো গাছগাছালি নেই। রাস্তার শেষ প্রান্তে নির্মাণ করা হয়েছে ১৫ বাই ৮ ফুটের কৃষকছাউনি। জাতীয় পতাকার আদলে লাল-সবুজ রঙে ঘরের দেয়াল সাজানো হয়েছে। অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নামা পাহাড়ি ঢলে হাওরে পানি উঠে যায়। এ কারণে মাটিভরাট করে ঘরটি একটি উঁচুতে স্থাপন করা হয়েছে। কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে ঘরে উঠতে হয়। ঘরের ভেতরে এক পাশে অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। হাওরের পাশ দিয়ে চলে গেছে কুলাউড়া-সিলেট রেলপথ। রেলপথ থেকেও কৃষকছাউনি নজর কাড়ে।
স্থানীয় বাসিন্দা পূর্ব সিংগুর নতুন কুঁড়ি ক্লাবের সদস্য মাছুম আহমেদ বললেন, তাঁদের গ্রাম থেকে হাওর বেশ দূরে পড়েছে। শুষ্ক ও বোরো মৌসুমে এলাকার তাঁরা হাওরে কাজে যান। তীব্র গরমে পরিশ্রান্ত কৃষকদের বিশ্রামের কোনো ব্যবস্থা আগে ছিল না। ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রপাত শুরু হলে আশপাশে কোথাও ঠাঁই নিতে পারতেন না। মূলত এ দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে কৃষকছাউনি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সেখানে ২০-২৫ জন কৃষক সেখানে বসতে পারেন।
মাছুম আহমেদ বলেন, স্থানীয় বাসিন্দা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী লুৎফুর রহমানসহ এলাকার কিছু সচ্ছল লোকের কাছ থেকে প্রায় দুই লাখ টাকা চাঁদা তুলে কৃষকছাউনি নির্মাণ করা হয়। জানুয়ারি মাসে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। এটির নির্মাণকাজে কোনো মিস্ত্রি লাগেনি। স্বেচ্ছাশ্রমে এলাকার লোকজন কাজে অংশ নেন। নলকূপ স্থাপনে প্রায় ২০ হাজার টাকা ব্যয় হয়।
এ কাজের উদ্যোক্তাদের প্রশংসা করে বরমচাল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মইনুল হক বলেন, ‘কৃষকছাউনি করার আগে উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে পরিকল্পনার কথা জেনে খুবি খুশি হই। আমরাও সাধ্যমতো তাঁদের সহযোগিতা করেছি। কৃষকদের দুর্ভোগ লাঘবে তাঁদের এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।’
এলাকাবাসী বলেন, কৃষকছাউনি শুধু কৃষকদের বিশ্রাম বা আশ্রয়স্থল নয়, ঘোরাঘুরির স্থানও। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন বিকেলে আশপাশের বিভিন্ন এলাকার বিশেষ করে তরুণ বয়সীরা মোটরসাইকেলে করে সেখানে ছুটে যান। তাঁরা ঘুরে বেড়ান। কৃষকছাউনির ভেতরে বেঞ্চে বসে আড্ডা দেন। কেউ কেউ ছবি, সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
কৃষক জাবেদ আহমদ ও শাহাব উদ্দিন জানালেন, কৃষকছাউনি হওয়ায় বেশ উপকার হয়েছে। রোদ-বৃষ্টিতে তাঁরা সেখানে প্রায়ই বিশ্রাম নেন। কেউ কেউ বেঞ্চে শুয়েও পড়েন। দখিনা বাতাসে প্রশান্তি লাগে।