নোয়াখালীর মুছাপুর রেগুলেটর নদীতে বিলীন হওয়ার পর থেকে ছোট ফেনী নদীর কোম্পানীগঞ্জ ও সোনাগাজীর অংশে দুই তীরে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে ভাঙনে ফসলি জমি, ফলের বাগান, রাস্তা ও কয়েক শ বসতভিটাও নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। নদীভাঙনের কারণে হুমকিতে রয়েছে শত শত বাড়িঘর। নদীভাঙন ঠেকাতে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বিস্তীর্ণ জনপদসহ অনেক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন গ্রামবাসী।
স্থানীয় লোকজন জানান, নোয়াখালী ও ফেনীর সীমান্তবর্তী মুছাপুর এলাকায় রেগুলেটর না থাকায় জোয়ারের তোড়ে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার চর চান্দিয়া, চর দরবেশ, বগাদানা ও চর মজলিশপুর ইউনিয়নের ছোট ফেনী নদীতীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে নদীভাঙনের কারণে বেশ কয়েকটি রাস্তা এবং ছোট ছোট কালভার্ট ও সেতু ভেঙে নদীতে বিলীন হয়েছে। বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম চর দরবেশ, কাজীরহাট, আউরারখিল, দাসপাড়া, কাটাখিলা, কুঠিরহাট ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা এতই বেশি যে রাত–দিন সমান তালে বাড়িঘর ও ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার বগাদানা ইউনিয়নের আউরারখিল ও দাসপাড়া এলাকায় নদীতীরের মানুষ ঘরবাড়ি ভেঙে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছেন। গাছগুলোও কেটে নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। কেউ কেউ নদীতীরে বাঁশ ও গাছ দিয়ে বাঁধ তৈরি করে বসতবাড়ি রক্ষার চেষ্টা করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, গত দুই মাসে উপজেলার অন্তত ২০টি এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়; কিন্তু এখনো স্থায়ীভাবে ভাঙনরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। আউরারখিল দাসপাড়া গ্রামের জেলেপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় বাসিন্দা রেখা রানী দাস ঘরের কিছু জিনিসপত্র সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, নদীটি তাঁদের বাড়ি থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে ছিল। গত আগস্ট মাসে হঠাৎ বন্যায় মুছাপুর রেগুলেটর ভেঙে নদীতে চলে যাওয়ার পর থেকে জোয়ারের সঙ্গে প্রতিদিন বাড়িঘরে পানি ঢুকে যায়। রাতে বাড়িতে থাকতে পারেন না। জোয়ারের পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ভাঙন শুরু হয়। তাঁদের আশপাশে শতাধিক বাড়ি ও বেশ কিছু গাছের বাগান ছিল। হঠাৎ বাড়িঘরের সঙ্গে নদীভাঙনে গাছপালাও বিলীন হয়ে গেছে। তাঁর ঘরের বেশির ভাগ অংশ নদীতে চলে গেছে। যেকোনো সময় পুরো বাড়ি নদীতে চলে যেতে পারে। তাই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন।
একই গ্রামের বিদেশি চন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, হঠাৎ ভাঙনের শিকার হয়ে পরিবারগুলো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন। তাঁদের অনেক দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে; কিন্তু এখানে স্থায়ীভাবে ভাঙনরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তাই মাত্র দুই মাসের মধ্যে কয়েক শ মানুষ গৃহহারা হয়েছেন। চোখের সামনে বাড়িঘর বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা কিছুই করতে পারছেন না। তাঁদের যেন দেখার যেন কেউ নেই।
আউরারখিল গ্রামের বাসিন্দা কামাল উদ্দিন বলেন, গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে ছোট ফেনী নদী বয়ে গেছে। বন্যার পর থেকে নদীতে প্রবল স্রোত বইছে। প্রায় দুই থেকে তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন চলছে। পাড় ভেঙে নদীতে আছড়ে পড়ছে। ১০ বছর আগে তাঁর বাড়ি নদীতে চলে যায়। এখন অন্যের জমিতে থাকেন। এ গ্রামেও ভাঙন হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত গ্রামের চার ভাগের দুই ভাগ এলাকা বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে যেভাবে ভাঙন চলছে, তাতে কোনো ব্যবস্থা না নিলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বহু ঘরবাড়ি বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আউরারখিল দুর্গামন্দির ও সমাজ কমিটির সভাপতি মেঘনাথ চন্দ্র দাস বলেন, তাঁদের পরিবারের সবাই এখন নদীভাঙনে সর্বস্বান্ত। তাঁর ২০ জন নিকটাত্মীয় গত দুই সপ্তাহে নদীভাঙনের শিকার হন। তাঁরা সব হারিয়ে এখন অন্যের বাড়ি ও বস্তিতে বসবাস করেন। এমন বহু পরিবার সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে।
মেঘনাথ চন্দ্র দাস আরও বলেন, এলাকাবাসী বালুভর্তি বস্তা ফেলে ও বাঁশ-গাছ দিয়ে ছোট ছোট বাঁধ নির্মাণ করে নিজেদের ঘরবাড়ি রক্ষার চেষ্টা করছেন; কিন্তু কিছুতেই তা টিকছে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেকশন কর্মকর্তা এ এম রকি প্রথম আলোকে বলেন, সোনাগাজী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নদীভাঙনের স্থানগুলো পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, মুছাপুর রেগুলেটর নদীগর্ভে বিলীনের পর শুধু পুরো সোনাগাজী উপজেলার চারপাশে নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ইতিমধ্যে শত শত ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।