সেন্ট মার্টিন সৈকতে অস্বাভাবিক জোয়ার, ঝুঁকিতে শতাধিক স্থাপনা
বৈরী আবহাওয়ার কারণে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সমুদ্রসৈকত উত্তাল রয়েছে। অস্বাভাবিক জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দ্বীপের দুই কিলোমিটার সৈকত। বিলীন হয়েছে প্রায় অর্ধশত নারকেলগাছ ও পাঁচটি বসতি। জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর বেড়িবাঁধ না থাকায় বিলীনের ঝুঁকিতে পড়েছে শতাধিক হোটেল-রেস্তোরাঁ, বসতবাড়িসহ নানা স্থাপনা।
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, টানা ১০ দিন ধরে জোয়ারের তাণ্ডব চলছে। এতে দ্বীপের পূর্ব-উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যভাগের গলাচিপা ও দক্ষিণ পাড়ায় অন্তত দুই কিলোমিটার সৈকতের বালিয়াড়ি ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপড়ে পড়েছে ৪০টির বেশি নারকেলগাছ। ঝোড়ো হাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি। বালুভর্তি বস্তা ফেলে সাগর-তীরবর্তী হোটেল-রিসোর্ট রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন কেউ কেউ। কিন্তু তাতে ভাঙন রোধ সম্ভব হচ্ছে না। সৈকতে সিসি ব্লক দিয়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মিত না হলে ৫০-৬০টি হোটেল রিসোর্ট, ৫০টি রেস্তোরাঁ, প্রায় ৪০০টি বসতবাড়ি, ৩০-৪০টি দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা বিলীন হতে পারে। সরেজমিনে অনুসন্ধান করে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে ইউনিয়ন পরিষদ।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এক যুগের বেশি সময়ে সৈকত ঘিরে তৈরি হয়েছে ১১৪টি আবাসিক হোটেল, রিসোর্ট ও কটেজ। আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপের চারদিকে বেড়িবাঁধ নেই। স্থায়ী বেড়িবাঁধের দাবিতে দ্বীপের মানুষ আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে দীর্ঘসময় ধরে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। প্রতিবছর অন্তত ১৫ লাখ পর্যটক সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ করেন। এতে আয় হয় শতকোটি টাকা। কিন্তু সেন্ট মার্টিনের সুরক্ষায় কারও নজর নেই।
তিন বছরে দ্বীপের উত্তর পাড়া, পূর্ব পাড়া, পশ্চিম ও দক্ষিণ পাড়ায় তিন শতাধিক ঘরবাড়ি, কবরস্থান, দোকানপাটসহ পাঁচ শতাধিক নারকেলগাছ বিলীন হয়েছে বলে দাবি করেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমেদ ও ফিরোজ আহমেদ খান। তাঁরা জানান, জোয়ারের তাণ্ডবে জিও ব্যাগ ফুটো হয়ে বালু সৈকতে মিশে যায়। দ্বীপের সম্পদ রক্ষা করতে হলে সিসি ব্লক দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডে লেখালেখি করা হয় অনেক। কিন্তু সাড়া মিলছে না। ঝুঁকিতে ইউনিয়নের ১০ হাজার ৭০০ মানুষ। পুরো দ্বীপে পাঁচ বছর আগেও ৯ হাজারের বেশি নারকেলগাছ ছিল। এখন আছে ৪ হাজার ৬০০টির মতো।
জোয়ারের ধাক্কায় বুধবার দুপুরে দ্বীপের পশ্চিম অংশে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাংলোবাড়ি সমুদ্রবিলাস, পাশের হোটেল অবকাশ, পান্না রিসোর্টসহ কয়েকটি দোকান প্লাবিত হয়েছে। এসব স্থাপনা রক্ষায় সেখানে কোনো বেড়িবাঁধ নেই।
সমুদ্রের জোয়ারের এমন তাণ্ডব এক যুগে দেখেননি বলে মন্তব্য করেন সেভ দ্য সেন্ট মার্টিন নামের একটি সংগঠনের সভাপতি আয়াত উল্লাহ। তিনি বলেন, পাঁচ-সাত বছরে তীব্র গতির চার থেকে পাঁচটি ঘূর্ণিঝড় দ্বীপে আঘাত হেনেছিল। এতে কক্সবাজারের টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া উপকূল লন্ডভন্ড হলেও তখন সেন্ট মার্টিনের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এখন জোয়ারের উচ্চতা যেমন বাড়ছে, তাণ্ডবও চলছে তত বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানির উচ্চতা দ্রুত বাড়ছে।
গতকাল বুধবার সকালের জোয়ারে দ্বীপের উত্তর পাশে পুলিশ ফাঁড়ি, হোটেল প্রসাদ প্যারাডাইস, এর পশ্চিম পাশের কবরস্থান ও উত্তর পাড়ার ২০-২৫টি বাড়ি প্লাবিত হয়েছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। এসব বাড়ির উঠানের ১০-১৫টি নারকেলগাছ গোড়ার মাটি সরে হেলে পড়েছে।
সেন্ট মার্টিনের উত্তর পাড়ার জেলে দলিলুর রহমান (৪৫) বলেন, গত বছরের জুলাই মাসের জলোচ্ছ্বাসে তাঁর বসতবাড়ির ১৫টি নারকেলগাছ বিলীন হয়েছিল। আশপাশের লোকজনের আরও শতাধিক নারকেলগাছ উপড়ে পড়েছিল। ভেঙে গিয়েছিল ১১টির বেশি ঘর।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জোয়ারের ধাক্কায় বুধবার দুপুরে দ্বীপের পশ্চিম অংশে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাংলোবাড়ি সমুদ্রবিলাস, পাশের হোটেল অবকাশ, পান্না রিসোর্টসহ কয়েকটি দোকান প্লাবিত হয়েছে। এসব স্থাপনা রক্ষায় সেখানে কোনো বেড়িবাঁধ নেই।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী তানজির সাইফ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সেন্ট মার্টিনের চারপাশে বেড়িবাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। এখন তা থেকে সরে এসেছে পাউবো। কারণ, বাঁধ নির্মাণ নিয়ে নানা মহলের বিরোধিতা আছে। প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এই দ্বীপে বাঁধ নির্মাণ হলে নাকি পরিবেশের ক্ষতি হবে।
স্থানীয় বাসিন্দা দলিলুর বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে ত্রাণ চাই না। নিরাপদ বসবাসের জন্য স্থায়ী বেড়িবাঁধ চাই। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ দরকার।’
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট দুই দফার নিম্নচাপের প্রভাবে ৮-৯ দিন ধরে সাগর উত্তাল রয়েছে জানিয়ে পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, জোয়ারের তাণ্ডবে সেন্ট মার্টিন সৈকতসহ হোটেল-রিসোর্টের সীমানা বিলীন হলেও পাউবোর এ ক্ষেত্রে করার কিছু নেই। তা ছাড়া উত্তাল সাগরের এমন পরিস্থিতিতে সেখানে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করাও ঝুঁকিপূর্ণ। ভাটার সময় কোনোমতে কাজ করা গেলেও কয়েক ঘণ্টা পরের জোয়ারে সেই বাঁধ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।