‘কারও কাছে হাত পাততে চাই না, নিজের বলে চলতে চাই’

শারীরিক প্রতিবন্ধী মানিক চন্দ্র মোদক ফুটপাতে শিশুদের বই বিক্রি করেন। রোববার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাতে
ছবি: প্রথম আলো

দুই বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন মানিক চন্দ্র মোদক। পরে তাঁর দুই পা চিকন হয়ে অকেজো হয়। সেই থেকে তিনি আর স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না। লাঠিতে ভর দিয়ে করতে হয় চলাফেরা। ১২ বছর আগে তাঁর মা–বাবা মারা যান। বাবাকে হারিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী মানিক চন্দ্র মোদককে জীবিকার সংগ্রামে নামতে হয়। সংসার চালাতে তিনি ফুটপাতে ২১ বছর ধরে বই বিক্রি করছেন। যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনোমতে চলে মাকে নিয়ে তাঁর সংসার।

নারায়ণগঞ্জ নগরের চাষাঢ়ায় বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাতে বই বিক্রি করেন ৩৯ বছর বয়সী শারীরিক প্রতিবন্ধী মানিক চন্দ্র মোদক। গতকাল রোববার বিকেলে ফুটপাতে কথা হলে তিনি বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারও কাছে হাত পাততে ভালো লাগে না, তাই বইয়ের ব্যবসা করি। বই অনেক ভালোবাসি, যত দিন বেঁচে থাকব, বইয়ের ব্যবসা করব।’

প্রতিদিন দুপুরের পর থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বই বিক্রি করেন। এর আগে চাষাঢ়া সোনালী ব্যাংকের সামনে বই বিক্রি করতেন। মানিক শহরের ভূঁইয়ারবাগ এলাকায় ভাড়া থাকেন। প্রতি মাসে তাঁকে ঘরভাড়া দিতে হয় সাড়ে আট হাজার টাকা। ব্যবসার আয় থেকে প্রতিদিন ঘরভাড়ার জন্য ৩০০ টাকা ও বাজারের জন্য ১৫০ টাকা তাঁর মায়ের কাছে জমা দেন। প্রতি বৃহস্পতিবার কিস্তির ৬০০ টাকা পরিশোধ করতে হয়। এ ছাড়া প্রতিদিন তাঁর নিজের চা-পানের জন্য ৫০ টাকা খরচ হয়। সম্প্রতি আশা সমিতি থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। ব্যবসার কাজে ২০ হাজার টাকা লাগিয়েছেন। বাকি ৪০ হাজার টাকা বোনের বাচ্চা হওয়ার সময় খরচ করেছেন।

মানিক শহরের ভূঁইয়ারবাগ এলাকায় ভাড়া থাকেন। প্রতি মাসে তাঁকে ঘরভাড়া দিতে হয় সাড়ে আট হাজার টাকা। ব্যবসার আয় থেকে প্রতিদিন ঘরভাড়ার জন্য ৩০০ টাকা ও বাজারের জন্য ১৫০ টাকা তাঁর মায়ের কাছে জমা দেন। প্রতি বৃহস্পতিবার কিস্তির ৬০০ টাকা পরিশোধ করতে হয়।
আয় হোক আর না হোক, খরচ তো বসে থাকে না। বহু চেষ্টা করেও পুঁজি বাড়াতে পারি না। বেচাকেনা কম হলে খরচের টাকা কীভাবে জোগাড় হবে, মাথা ঘুরতে থাকে।
মানিক চন্দ্র মোদক, ফুটপাতে বই বিক্রেতা

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সামান্য আয় দিয়ে চলতে কষ্ট হয় জানিয়ে মানিক চন্দ্র মোদক বলেন, ‘আয় হোক আর না হোক, খরচ তো বসে থাকে না। বহু চেষ্টা করেও পুঁজি বাড়াতে পারি না। বেচাকেনা কম হলে খরচের টাকা কীভাবে জোগাড় হবে, মাথা ঘুরতে থাকে।’

মানিকের বাবা দীপক চন্দ্র মোদকও বই বিক্রেতা ছিলেন। তিনি ফুটপাতে শিশুদের বই বিক্রি করতেন। দীপক চন্দ্র মোদকের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। তাঁদের মধ্যে সবার বড় মানিক চন্দ্র মোদক। মানিকের মা দুলালী রানী মোদক গৃহিণী। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট ভাই সুমন ঝুটের ব্যবসা করলেও স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা থাকেন। তবে তাঁদের চাল কেনার জন্য টাকা দেন সুমন।

মামার বাড়ি চাঁদপুরে মধুসূদন উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন মানিক। বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় পড়াশোনা করা হয়নি। বাবার কাছ থেকেই তাঁর বইয়ের ব্যবসার হাতেখড়ি। বাবার মৃত্যুর পর চার হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে বইয়ের ব্যবসা শুরু করেন। অনেক কষ্ট করে খেয়ে–পরে চললেও ব্যবসার পুঁজি বাড়াতে পারছেন না। এ কারণে দোকানে অনেক আইটেমের বই তুলতে পারেন না।
মানিকের বই বিক্রির তালিকায় আছে আদর্শ লিপি, ম্যাজিক বই, ইংরেজি এবিসিডি বই, গল্পের বই, পশুপাখির পরিচিতি বই, ফলের পরিচিতি বই, ফুলের নাম, মাছের নামের বই, ম্যাজিক বই, মটু-পাতলু প্রভৃতি। প্রতিদিন বই বিক্রি করে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা লাভ হয়। অনেক সময় তা–ও হয় না। তখন চলতে অনেক কষ্ট হয়। মানিক বলেন, মার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের জন্য বই কিনে নিয়ে যান। ম্যাজিক বইটি বেশি বিক্রি হচ্ছে। অন্য বইও বিক্রি হয়।

শারীরিক প্রতিবন্ধী মানিক চন্দ্র মোদক ফুটপাতে শিশুদের বই বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। রোববার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাতে
ছবি: প্রথম আলো

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও জীবনসংগ্রাম করে যাচ্ছেন মানিক। তিনি যাতে সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী ভাতা পান, সে ব্যবস্থা করা হবে।

সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ঢাকার বাংলাবাজার থেকে বই কিনে আনেন মানিক। এ জন্য চাষাঢ়া থেকে উৎসব পরিবহনের গাড়িতে করে গুলিস্তানে গিয়ে নামেন। সেখান থেকে রিকশায় বাংলাবাজারে যান। বাসে উঠতে চালকের সহকারী কিংবা অনেক সময় যাত্রীরাও তাঁকে সহযোগিতা করেন। মানিক বলেন, ট্রেনে ভাড়া কম লাগত। কিন্তু ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় বাসে ঢাকা থেকে বই আনতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা খরচ হয়ে যায়। আগে বইয়ের কার্ড ও কাগজের দাম কম ছিল। এখন বইয়ের দাম বেশি হওয়ায় আগের মতো লাভ হয় না।

শিশুদের বই বিক্রি করেন শারীরিক প্রতিবন্ধী মানিক চন্দ্র মোদক। রোববার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাতে
ছবি: প্রথম আলো

ফুটপাতের অন্য দোকানিরাও মানিকের সম্পর্কে ভালো জানেন। তাঁরা মানিককে সহযোগিতা করেন। ব্যাগ ব্যবসায়ী সুকুমার বলেন, প্রতিবন্ধী হলেও ভিক্ষাবৃত্তি না করে মানিক ব্যবসা করছেন। অনেক কষ্ট করে মায়ের সঙ্গে থাকেন। সামান্য যা আয় করেন, তা দিয়ে সংসারের খরচ চালান।

চার বছরের শিশু মাঈশা আক্তারের জন্য ১২০ টাকা দিয়ে বই কিনেছেন গৃহিণী আকলিমা বেগম। তাঁর বাড়ি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার বক্তাবলীর রাজাপুর এলাকায়। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী হয়েও মানিক কাজ করে টাকা উপার্জন করছেন। সমাজে এমন নজির খুবই কম দেখা যায়।