কিডনি পাচারকারী চক্র: ভারতে গ্রেপ্তার রাসেলের গ্রামের লোকেরা অবাক, সম্পর্ক নেই বললেন মা
অবৈধভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ভারতীয় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন বাংলাদেশের যুবক রাসেল। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার ধরমপুর ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা রাসেলের সম্পর্কে তাঁর পরিবারের সদস্যরা কথা বলতে নারাজ। তাঁরা বলছেন, রাসেলের সঙ্গে পরিবারের কোনো যোগাযোগ নেই। সম্প্রতি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর জানতে পারেন রাসেল দিল্লিতে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, ২০১৩ সালের দিকে এসএসসি পরীক্ষার পর রাসেল গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে যান। এরপর ভারতে চাকরি করেন বলে শুনেছেন কেউ কেউ। কিডনি কেনাবেচা চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার খবরে তাঁরা অবাক হয়েছেন।
কয়েক মিনিট পর রাসেলের মা আলেকা খাতুন বের হয়ে বারান্দায় আসেন। তিনি বলেন, ‘রাসেলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নাই। কোনো যোগাযোগও নাই। জানতাম ভারতে চাকরি করে। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।’ কত দিন যোগাযোগ নেই, জানতে চাইলে তিনি বলেন, তা সাত থেকে আট বছর। এরপরেই তিনি ঘরের ভেতর গিয়ে দরজা বন্ধ করেন।
অবৈধভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত সপ্তাহে ভারতের দিল্লিতে বিজয়া কুমারী (৫০) নামের এক চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করে ভারতীয় পুলিশ। চক্রটি বাংলাদেশ ও ভারতে সক্রিয়। এর আগে চক্রে জড়িত তিন বাংলাদেশিকে গত মাসে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা হলেন কুষ্টিয়ার রাসেল আহমেদ, তাঁর সহযোগী ঢাকার বাসিন্দা মিয়া (২৮) ও মোহাম্মদ রোকন (২৬)। গ্রেপ্তারের সময় রাসেলের কক্ষ থেকে ৯টি পাসপোর্ট, ২টি ডায়েরি ও একটি রেজিস্টার পাওয়া যায়। এসব পাসপোর্ট কিডনিদাতা ও গ্রহীতাদের। রোকনের কাছ থেকে ২০টি স্ট্যাম্প ব্যাগ জব্দ করেছে পুলিশ।
ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাসেল, মোহাম্মদ সুমন মিয়া, ইফতি ও ত্রিপুরার রতীশ পাল নিজ নিজ এলাকা থেকে সম্ভাব্য কিডনিদাতাদের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে দিল্লিতে আনতেন। দাতারা চার থেকে পাঁচ লাখ রুপির বিনিময়ে কিডনি দিতেন। আর গ্রহীতার কাছ থেকে ২৫–৩০ লাখ রুপি আদায় করত চক্রটি। ইফতি ছাড়া অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ভেড়ামারার হিসনা নদীর পাশ দিয়ে রামচন্দ্রপুর গ্রামের একমাত্র পাকা সড়কটি গেছে। সড়কের পাশেই রাসেলদের বাড়ি। গতকাল শুক্রবার বিকেলে আধা পাকা বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির বাইরে দুই পাশে সিসি ক্যামেরা লাগানো। কলিংবেল চাপলে ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। পাঁচ মিনিট অপেক্ষার পাশের দোতলা বাড়ির ভেতর থেকে এক তরুণ বের হন।
সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে রাসেল সম্পর্কে জানতে চাইলে আমির হামজা নামের ওই তরুণ শুরুতে তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। আলাপের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা সাংবাদিকেরা যা জানেন, আমরাও সেভাবে জেনেছি। রাসেলকে দিল্লিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিউজে ও ফেসবুকে দেখেছি। কিন্তু প্রকৃত কারণ জানি না।’
বাড়ির সামনে সড়কের পাশে একটি বাঁশের মাচাতে বসে আলাপে আমির হামজা জানান, রাসেলের পুরো নাম রাসেল আহমেদ (৩০)। প্রায় ১২ বছর আগে প্রবাসে থাকার সময় তাঁর বাবা আবুল কালাম সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তিন ভাইয়ের মধ্যে রাসেল সবার ছোট।
আমির হামজার সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রতিবেশী সেলিম হোসেন আসেন। তিনি জানালেন, রাসেল তাঁর দুই বছরের ছোট। গ্রামে তাঁরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একসঙ্গে পড়ালেখা করেছিলেন। ২০১৩ সালের দিকে রাসেল এসএসসি পরীক্ষার পর ঢাকাতে চলে যান। এ ছাড়া তাঁর বিষয়ে তেমন জানা নেই। তবে শুনেছিলেন, রাসেল নাকি পরে ভারতে গিয়েছেন।
প্রায় আধা ঘণ্টা পর আবার রাসেলের বাড়িতে কলিংবেল বাজানো হয়। কয়েক মিনিট পর রাসেলের মা আলেকা খাতুন বের হয়ে বারান্দায় আসেন। তিনি বলেন, ‘রাসেলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নাই। কোনো যোগাযোগও নাই। জানতাম ভারতে চাকরি করে। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।’ কত দিন যোগাযোগ নেই, জানতে চাইলে তিনি বলেন, তা সাত থেকে আট বছর। এরপরেই তিনি ঘরের ভেতর গিয়ে দরজা বন্ধ করেন।
ফেরার পথে রাসেলের বাড়ি থেকে কয়েক বাড়ি পর কথা হয় মোহাম্মদ রনি নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি বললেন, গত ঈদুল ফিতরের কয়েক দিন আগে রাসেল বাড়িতে এসেছিলেন। কিছুদিন থাকার পর চলে যান। তবে রাসেল ঢাকায় থাকেন, আবার শুনেছেন ভারত থাকেন। এর বেশি কিছু জানা নেই।
গ্রামের শেষ প্রান্তে এক চায়ের দোকানে বসেছিলেন বেশ কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। সঙ্গে কয়েকজন যুবক–তরুণ। রাসেল সম্পর্কে এক বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বললেন, রাসেলের ভারতে গ্রেপ্তারের বিষয়টি শুনেছেন। তবে কিডনি কেনাবেচা চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকবে, সেটা বিশ্বাস করতে পারছেন না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে রাসেল আহমেদ নামে আইডি রয়েছে রাসেলের। ওই আইডিতে উল্লেখ করা হয়েছে, দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হাসপাতালে ট্রান্সলেটর হিসেবে কাজ করেন রাসেল। দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছেন। এমনকি দিল্লির আর কে পুরামে দিল্লি পাবলিক স্কুলেও পড়েছেন। থাকেন দিল্লিতে।
ভেড়ামারায় একসময় চাকরি করা এক সরকারি কর্মকর্তা রাসেলের বিষয়ে কিছু তথ্য দিলেন। তিনি পরিবার নিয়ে দিল্লি অ্যাপোলো হাসপাতালে গিয়েছিলেন। কৌতূহলবশত তাঁর স্ত্রী সহযোগিতার জন্য ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেলেন। সে সময় রাসেল যোগাযোগ করে খুব ভালো সহযোগিতা করেছিলেন। সেই সহযোগিতার কথা তিনি সেই সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও জানিয়েছিলেন। তবে বর্তমানের রাসেলের বিষয়টি জানার পর তিনি হতবাক হয়েছেন।
কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস ও মিডিয়া) পলাশ কান্তি নাথ প্রথম আলোকে বলেন, রাসেলের বিষয়ে কিছুই জানা নেই। যদি কেউ রাসেলের মাধ্যমে প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ দেন, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।