২১ আসনের ১৩টিতেই ভোট ছিল ‘একতরফা’

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথম ভোট দিচ্ছেন একজন তরুণ ভোটার। গত রোববার বরিশালের জগদীশ সারস্বত গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজেছবি: সাইয়ান

বরিশাল বিভাগের ১৫টি আসনে দলীয় প্রার্থী দিয়ে ১৪টিতে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। একটিতে হেরেছে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে। বিভাগের মোট ২১টি আসনে যত ভোট পড়েছে, তার ৫৮ দশমিক ২৯ শতাংশ গেছে আওয়ামী লীগের জয়ী ১৪ প্রার্থীর বাক্সে। আর প্রতীক হিসেবে নৌকা পেয়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ ভোট।

গত রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ভোটের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বরিশাল বিভাগের ২১টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৭টিতে বিজয়ী প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেননি ‘নিকটতম’ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। এর মধ্যে ১৩টি আসনে নির্বাচন হয় একবারেই ‘একতরফা’। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় আওয়ামী লীগ ও জোটের প্রার্থীরা এসব আসনে ছিলেন নির্ভার। তাঁরা জয়ও পেয়েছেন হেসেখেলে।

এবারের নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে নামতে উৎসাহিত করেছিল আওয়ামী লীগ। ভোটের মাঠের চিত্র বিশ্লেষণ করে নির্বাচনের আগে নির্বাচনী কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ নেতারা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ধারণা করা হচ্ছে অন্তত ৮টি আসনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। তবে ৮টি আসনের মধ্যে কেবল ৪টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। সেসব আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। ভোটের হিসাবে বাকি ৪টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রতিফলন দেখা যায়নি। বিশেষ করে ১৩টি আসনে ভোট হয়েছে একেবারেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। এর মধ্যে বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া), বরিশাল-৪ (মেহেন্দীগঞ্জ-হিজলা), বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী), বরগুনা-২ (বামনা-বেতাগী-পাথরঘাটা), ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া), ঝালকাঠি-২ (সদর-নলছিটি), ভোলা-১ (সদর), ভোলা-২ (দৌলতখান ও বোরহানউদ্দিন), ভোলা-৩ (তজুমদ্দিন ও লালমোহন) ও ভোলা-৪ (মনপুরা ও চরফ্যাশন) আসনে ভোট হয়েছে অনেকটা একতরফা।

ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই ১৩ আসনের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন ভোলা-৪ আসনের নৌকার প্রার্থী আবদুল্লাহ আল ইসলাম ওরফে জ্যাকব। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে ২ লাখ ৪০ হাজার ৪৩৫ ভোট বেশি পেয়েছেন। সবচেয়ে কম ব্যবধানে জিতেছেন ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শাহজাহান ওমর। অবশ্য তিনিও নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে ৯৩ হাজার ৮৫৪ ভোট বেশি পেয়েছেন।

আরও পড়ুন

এসব আসনের ভোটার ও নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের প্রার্থীদের জয় অনেকটাই নিশ্চিত ছিল। ফলে এসব আসনের প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায়ও একধরনের উদাসীন ছিলেন। দু-একটি আসনে প্রার্থীরা মাঠেই নামেননি। বরিশাল-৫ (সদর-মহানগর), বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রচার-প্রচারণায় শেষ দিকে কিছুটা গতি বাড়িয়ে উত্তাপ ছড়ালেও ভোটের ফলাফলে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি।}

৫৮ শতাংশ ভোটই পেয়েছেন নৌকার জয়ীরা

বরিশাল আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র বলছে, এবারের নির্বাচনে বরিশাল বিভাগে মোট ভোটার ৭৪ লাখ ২৩ হাজার ৫২২ জন। এর মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৩১ লাখ ৫৪ হাজার ৯৯৬ জন, যা মোট ভোটের ৪২ দশমিক ৫০ শতাংশ।

বিভাগে এবার ১৫টি আসনে আওয়ামী লীগের সরাসরি প্রার্থী ছিল। ১৪ আসনে জয়ী আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ভোট পেয়েছেন ১৮ লাখ ৩৯ হাজার ৩৬২, যা বিভাগে মোট প্রদত্ত ভোটের (কাস্টিং ভোট) ৫৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। যে আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হেরে গেছেন, তিনি পেয়েছেন বিভাগের মোট প্রদত্ত ভোটের ১ দশমিক ৭১ শতাংশ।

আরও পড়ুন

এদিকে মহাজোটের শরিক দল থেকে দুটি আসনে নৌকা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন দুজন প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে বরিশাল-২ আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ১ লাখ ২১ হাজার ৩৭৫ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তিনি বিভাগে মোট প্রদত্ত ভোটের ৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। পিরোজপুর-২ আসনে ৭০ হাজার ৬৮১ ভোট পেয়ে হেরে গেছেন জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তিনি বিভাগে মোট প্রদত্ত ভোটের ২ দশমিক ২৪ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। ফলে প্রতীক বিবেচনায় নিলে নৌকা পেয়েছে মোট ভোটের ৬৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।

ফলাফলে এটা স্পষ্ট যে এতে যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের অথবা ক্ষমতাসীন দলের অনুগত। আবার যাঁরা পরাজিত হয়েছেন, তাঁরাও সরাসরি ওই দলের কিংবা অনুগত প্রার্থী।
রফিকুল আলম, সাধারণ সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), বরিশাল নগর কমিটি

আলোচনায় দুই হেভিওয়েটের হার

বরিশাল বিভাগে ফলাফল ঘোষণার পর সবচেয়ে আলোচনা চলছে এ অঞ্চলের দুই হেভিওয়েট প্রার্থী জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন ও সাবেক উপমন্ত্রী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর হার। পিরোজপুর-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন মহারাজের কাছে পরাজিত হয়েছেন নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করা আনোয়ার হোসেন। এ আসন থেকে সাতবার জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়া আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এই প্রথম কোনো নির্বাচনে হারলেন। বিজয়ী প্রার্থী মহিউদ্দিন মহারাজ একসময় আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। অবশ্য ২০০১ সালের নির্বাচনে আনোয়ার হোসেন পিরোজপুর-২ ও বরগুনা-২—এ দুটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পিরোজপুরে জিতলেও বরগুনা-২ আসনে হেরে গিয়েছিলেন।

এদিকে বরগুনা-১ আসনে ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এবার সপ্তমবারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তিনি পাঁচবার এই আসনের সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। ২০০১ সালে তিনি হেরেছিলেন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী প্রয়াত দেলোয়ার হোসেনের কাছে। এবার হারলেন দলের তরুণ নেতা ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম সরোয়ার ওরফে টুকুর কাছে। ভোটের ফলাফলে ধীরেন্দ্র তৃতীয় হয়েছেন।

ঘোষিত ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভাগের ২১ আসনের মধ্যে ৮টি আসনে এবার নতুন মুখ বিজয়ী হয়েছেন। আর ১৩টি আসনে একাদশ সংসদের সদস্যরাই জয়ী হয়েছেন। একাদশ সংসদের সদস্য হিসেবে যে ১৩ জন জয়ী হয়েছেন, এর মধ্যে বরিশাল-৪ আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ। পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ। ফলে পঙ্কজ নাথ শেষ সময়ে এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। কিন্তু দ্বৈত নাগরিকত্ব ইস্যুতে শাম্মীর প্রার্থিতা বাতিল হওয়ায় পঙ্কজ নাথ খুব সহজে জয় পান জাতীয় পার্টির কম পরিচিত মিজানুর রহমানের বিপক্ষে। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি এবার বিভাগের দুটি আসনে জয়ী হয়েছে।

ভোটার উপস্থিতিই ছিল চ্যালেঞ্জ

বিএনপিসহ বিরোধী অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে আসেনি; বরং এসব দল নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছিল। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোটভুক্ত দল ও ‘কিংস পার্টি’ তকমা পাওয়া দলের প্রার্থীরা অধিকাংশ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ ছিল কম। এমন অবস্থায় কেন্দ্রে ভোটার আনাই ছিল মূল চ্যালেঞ্জ।

বরিশাল আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা ভোট গ্রহণের আগে বিভাগের আসনভিত্তিক একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। তাতে ধারণা করা হয়েছিল, যেসব শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে, সেখানে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি এবং যেসব আসনে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, সেসব আসনে ২০ শতাংশের মতো ভোটার উপস্থিতি হতে পারে। সব মিলিয়ে গড় উপস্থিতি ধারণা করা হয়েছিল ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশ। তবে ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভোট পড়েছে তার চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি।
বরিশাল আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, এবার বরিশালের সব কটি আসনেই সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা। ভোটারদের অংশগ্রহণও ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। এবার বিভাগে ৪২ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে।

আরও পড়ুন

তবে এই নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ বলা সমীচীন হবে না বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বরিশাল নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ফলাফলে এটা স্পষ্ট যে এতে যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের অথবা ক্ষমতাসীন দলের অনুগত। আবার যাঁরা পরাজিত হয়েছেন, তাঁরাও সরাসরি ওই দলের কিংবা অনুগত প্রার্থী। এবার বিভাগের কিছু আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় প্রচার-প্রচারণায় অনেকটা উত্তাপ ছিল, এটা সত্য। এতে ওই সব আসনে ভোটার উপস্থিতি কিছুটা বেশি হওয়ায় ভোট পড়ার হার বেড়েছে। আর যেসব আসনে শক্তিশালী প্রার্থী ছিল না, সেসব আসনে ভোটকেন্দ্র ফাঁকাই ছিল।