সিলেট সিটি করপোরেশনের ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের আখালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটকক্ষ ৯টি। কোনো কক্ষেই আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থীর ছাড়া অন্য কারও এজেন্ট পাওয়া যায়নি। আজ বুধবার সকাল ৯টা ২৪ মিনিটে ৬ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, এক নারী পরপর অন্য তিন নারী ভোটারের সঙ্গে গোপনকক্ষে ঢুকে ব্যালট প্যানেলের সুইচে চাপ দিয়ে ভোট দেন। পুরো বিষয়টি পাশে দাঁড়িয়ে তদারকি করছিলেন নৌকার এজেন্ট মো. আজাদ মিয়া।
গোপনকক্ষে ঢুকে পড়া ত্রিশোর্ধ্ব ওই নারী নিজেকে জ্যোতি বেগম নামে পরিচয় দেন। তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, যে তিন নারীর ভোটে তিনি সহযোগিতা করেছেন, তাঁরা তাঁর মা ও চাচি। তাঁরা বয়স্ক হওয়ায় ইভিএমে ভোট দেওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারছিলেন না। তাই তিনি সহযোগিতা করেন।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ওই কক্ষে দায়িত্বরত সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মনিকা রায় বলেন, বয়স্ক মানুষ হওয়ায় তাঁরা (মা ও চাচি) ইভিএমে ভোট দিতে পারছিলেন না। তাই বিষয়টি দেখিয়ে দেওয়ার জন্য ওই ভোটারদের মতামত নিয়েই তাঁদের আত্মীয় ওই নারীকে গোপনকক্ষে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়।
ইভিএমে ধীরগতি
৬ নম্বর কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অন্তত ৮ জন নারী ভোটার অভিযোগ করেন, সকাল আটটা থেকে তাঁরা কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও সকাল সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ভোট দিতে পারেননি। ধীরগতিতে ভোট নেওয়ায় এ সমস্যা হচ্ছে। পরে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ৬ নম্বর কক্ষের মোট ভোটার ৩৭৮ জন। সকাল ৯টা ২৪ মিনিট পর্যন্ত ২২ জন এবং ৯টা ৪৬ মিনিট পর্যন্ত ৩২ জন ভোট দিতে পেরেছেন। এ হিসাবে একজন ভোটারের ভোট দিতে সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে চার মিনিট করে। এ সময় কক্ষের সামনে অন্তত শতাধিক ভোটার সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
ভোটকক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আখালিয়া কারিপাড়া এলাকার ভোটার গৃহিণী জোসনা বেগম (৩৩) অভিযোগ করেন, দুই ঘণ্টা সারিতে দাঁড়িয়ে থাকার পরও ধীরগতির কারণে তিনি এখনো ভোট দিতে পারেননি। একই সারিতে থাকা মদনমোহন কলেজের সম্মান প্রথম বর্ষের ছাত্রী তানজু আক্তার একই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, তিনি নতুন ভোটার। এবারই প্রথম ভোট দিচ্ছেন। তুলনামূলকভাবে যোগ্য প্রার্থীকেই ভোট দেবেন।
পরে ভোটকেন্দ্রটির অন্যান্য কক্ষ ঘুরেও ভোট গ্রহণে ধীরগতির অভিযোগ পাওয়া যায়। এর কারণ হিসেবে ভোট গ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, প্রথমবারের মতো ইভিএমে ভোট হওয়ায় অভিজ্ঞতার অভাবে অনেকে ভোট দিতে অসুবিধায় পড়ছেন। অধিকাংশ ভোটার ভোট দিতে কমপক্ষে পাঁচ থেকে সাত মিনিট সময় নিচ্ছেন। এ ছাড়া অধিকাংশ কক্ষ অন্ধকার থাকায়ও ভোট নিতে প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে। এতে পর্যাপ্ত ভোটার উপস্থিত হলেও ভোট গ্রহণে বিলম্ব হচ্ছে।
৯ নম্বর কক্ষের দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তানিম চৌধুরী জানান, তাঁর কক্ষে মোট ভোটারের সংখ্যা ৩৭৯। এর মধ্যে প্রথম দেড় ঘণ্টায় ভোট পড়েছে মাত্র ১৭টি। যদিও এ কক্ষের সামনে অন্তত শতাধিক নারীকে ভোট দেওয়ার জন্য সারিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
ইভিএম বিকলে ভোট বন্ধ ৪০ মিনিট
সকাল ৯টা ৩৮ মিনিটে কেন্দ্রের ৩ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, ইভিএম বিকল হয়ে পড়ায় ভোটাররা ভোট দিতে পারছিলেন না। অনেকক্ষণ ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটাররা এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিলেন। মো. জামাল মিয়া ও ছালেক মিয়া নামের দুই ভোটার এ সময় অভিযোগ করেন, ভোট শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত চার থেকে পাঁচবার ব্যালটের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় তাঁরা ভোট দিতে পারছেন না। কয়েকবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সকাল ১০টা পর্যন্ত এ কক্ষে অন্তত ৪০ মিনিট ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল বলে তাঁরা দাবি করেছেন।
৩ নম্বর কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এটি পুরুষদের ভোটকক্ষ। এখানে মোট ভোটার ৩৫৪ জন। সকাল ৯টা ৩৭ মিনিট পর্যন্ত ২১ জন ভোট দিতে পেরেছেন। অথচ কক্ষের সামনে শতাধিক ভোটার দাঁড়িয়ে আছেন।
বিকল হয়ে পড়া ব্যালট প্যানেলটি সারাতে চেষ্টা করছিলেন কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেটা এন্ট্রি অপারেটর হুমায়ুন কবির। তিনি জানান, ব্যালট প্যানেলের স্ক্রিনে অনেক ভোটার শক্তভাবে চাপ দেওয়ায় যন্ত্রটি বিকল হয়ে পড়েছে। অনেক চেষ্টা করেও সমাধান করা যাচ্ছে না।
পরে সকাল ১০টার দিকে নতুন আরেকটি ইভিএম এনে ৩ নম্বর কক্ষে আবার ভোট গ্রহণ শুরু করা হয়। এ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিরুপম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ইভিএম জটিলতার কারণে কেবল ৩ নম্বর কক্ষে ভোট গ্রহণ সাময়িক সময় বন্ধ ছিল। পরে আরেকটি যন্ত্র বসিয়ে বিষয়টির সমাধান করা হয়েছে। এ ছাড়া ইভিএমে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা না থাকায় ভোট গ্রহণে ধীরগতি হচ্ছে।
গোপন বুথে বারবার নৌকার এজেন্টের উঁকি
এদিকে সকাল ৯টা ২০ মিনিটের দিকে কেন্দ্রটিতে প্রবেশের সময় সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাইম আহমদের নেতৃত্বে স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কেন্দ্রের ভেতরে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। সকাল সোয়া ১০টার দিকে কেন্দ্র থেকে বেরোনোর সময়ও তাঁদের দেখা গেছে। এ সময় তাঁদের মাঝেমধ্যে বিভিন্ন ভোটকক্ষের ভেতরেও যেতে দেখা গেছে। এ ছাড়া ৬ নম্বর ভোটকক্ষে থাকা নৌকার এজেন্ট মো. আজাদ মিয়া বারবার ভোটদানে সহযোগিতা করার কথা বলে ওই বুথের গোপনকক্ষের পাশে গিয়ে উঁকি দিচ্ছিলেন।
এ বিষয়ে মো. আজাদ মিয়া বলেন, ‘ভোট কীভাবে দিতে হয়, অনেকে তা বুঝতে পারছেন না, তাই বলে দিচ্ছিলাম। সবাই যাঁর যাঁর ভোট নিজেরাই দিচ্ছেন।’
কেন্দ্রটিতে অবস্থান করে দেখা যায়, নারী ও পুরুষ উভয় সারিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোটার আছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আখালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের মোট ভোটার ৩ হাজার ২৭৮ জন। এ কেন্দ্রটিকে ‘সাধারণ’ কেন্দ্র হিসেবে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।