নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের গাজী টায়ারস কারখানায় লুটপাটের পর আগুন দেওয়ার ঘটনায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান চেয়ে এবার থানা ঘেরাও করেছেন তাঁদের স্বজনেরা। আজ বুধবার সকাল থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত নিখোঁজ ব্যক্তিদের অর্ধশতাধিক স্বজন থানা প্রাঙ্গণে অবস্থান নেন। এ সময় তাঁরা পুলিশের কাছে স্বজনদের সন্ধান দাবি করেন।
এর আগে গত ২৯ ডিসেম্বর একই দাবিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তাঁরা।
সকালে বিক্ষোভরত স্বজনেরা থানা ভবনের ভেতরে ঢুকতে চাইলে কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেয় পুলিশ। পরে তাঁরা থানা ফটকে অবস্থান নেন। পুলিশের পক্ষ থেকে স্বজনদের আশ্বস্ত করা হলে বেলা দুইটার দিকে তাঁরা থানা ফটক ছাড়েন।
স্বজনদের দাবি, আগুনের ঘটনার চার মাস পেরিয়ে গেলেও নিখোঁজদের কোনো সন্ধান দিতে পারেনি সরকারি কোনো সংস্থা। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তাঁদের মৃত্যু হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলছেন না প্রশাসনের লোকজন। কারখানার ভেতরে দেহাবশেষ কিছু আছে কি না, সে ব্যাপারেও অনুসন্ধান চালানো হয়নি। নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান দিতে প্রশাসন অবহেলা করছে বলেও অভিযোগ করেন স্বজনেরা।
সকালে থানার সামনে কথা হয় নিখোঁজ আমানউল্লাহর বৃদ্ধ মা রাশিদা বেগমের সঙ্গে। বৃদ্ধার অভিযোগ, ‘পুলিশ-প্রশাসন তালিকা কইরা কাগজ ড্রয়ারে থুইয়া দেয়।’ তাঁর ছেলের কোনো খোঁজ দেয় না। সরকার কিছু চাইলে তারা তা–ও দিতে রাজি। তবুও ছেলের সন্ধান চান তিনি।
৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ফারজানা বেগম। সন্তানসম্ভবা এ নারী শীতের সকালে নিখোঁজ স্বামীর ছবি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন রূপগঞ্জ থানার সামনে। সঙ্গে তাঁর ছয় বছরের শিশুসন্তান। গত সাড়ে চার মাস পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে এভাবেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি।
রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী এলাকার বাসিন্দা ফারজানার দাবি, তাঁর কাপড় বিক্রেতা স্বামী মো. ফয়সাল (৩০) গত ২৫ আগস্ট রাত থেকে নিখোঁজ। সেই রাতে রূপসীর গাজী টায়ারস কারখানায় আগুনের ঘটনার পর ভাতিজাকে খুঁজতে কারখানার ভেতরে যান তিনি। ভাতিজা বাড়ি ফিরলেও ফয়সালের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
থানার সামনে কথা হয় স্টিল মিলের শ্রমিক ফয়েজ আহমেদের মা মনোয়ারা বেগম, ফল বিক্রেতা সুমনের মা গোলেনূর বেগম, সিমেন্ট কারখানার শ্রমিক মুন্নার মা নূর বেগম, মিস্ত্রি শাহীনের মা শাহানা ও সজীবের মা কুলসুম বেগমের সঙ্গে। তাঁরাও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সন্ধান দাবি করেন।
নূর বেগম বলেন, ‘আমরা এসপি, ডিসি, ওসি সবার কাছে গেছি। সবাই খালি ধৈর্য ধরতে কয়। কেউ আমাগো দুঃখ বোঝে না।’
উপজেলার ছাতিয়ান এলাকার বাসিন্দা রাজমিস্ত্রি হাসান আলীর নামও নিখোঁজের তালিকায় রয়েছে। তাঁর স্ত্রী শান্তা বেগমকেও দেখা যায় থানার সামনে। স্বামীর সন্ধান না পেয়ে দিশাহারা শান্তা জানান, এখন তাঁর সাড়ে তিন বছরের ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। সন্তানকে নিয়ে অর্থকষ্টে ভুগছেন। এরই মধ্যে ধারদেনা করে এই দপ্তর থেকে ওই দপ্তরে ছোটাছুটি করছেন। প্রশাসনের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ওনি (হাসান) যদি আগুনে পুইড়া মইরা গিয়া থাকেন, তাইলে হাড্ডি দিবো, নাইলে ছাই দিবো। আর দিতে না পারলে অন্তত কইবো যে হ্যায় মারা গেছে। কিন্তু কেউ কিছ্ইু কয় না। শিশু একটা বাচ্চা রাইখা তার বাবায় চইলা গেছে। আমার দুঃখ বোঝার মতো কেউ নাই।’
শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ২৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন গাজী টায়ারসের ছয়তলা ভবনে লুটপাটের পর আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ সময় কারখানাটিতে লুটপাটের সময় সেখানে থাকা শতাধিক মানুষ নিখোঁজ হন। টানা পাঁচ দিন কারখানায় আগুন জ্বলার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও নিখোঁজ ব্যক্তিদের দেহাবশেষ উদ্ধারে কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি প্রশাসনের। উল্টো তারা ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে তাদের কার্যক্রম সমাপ্ত করে। এ ঘটনায় গত ১২ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসনের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এ অগ্নিকাণ্ডে ১৮২ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানানো হয়।
রূপগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘নিখোঁজদের একটি তালিকা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পুলিশের কাছে দেওয়া হয়েছে। এই তালিকা ধরে কাজ করছে পুলিশ। নিখোঁজদের সপক্ষে তথ্য যাচাই করছি। তাঁদের ব্যাপারে ডেটাগুলো কালেক্ট করছি। তবে এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।’