‘বাদাম বেইচ্চা যা পাই, তা দিয়া ঠিকমতো সংসার চলে না’

অসুস্থ শরীর নিয়েও ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বাদাম বিক্রি করেন হানিফ ব্যাপারী (৬৬)। চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলা সদরের কলেজগেট এলাকায় গতকাল দুপুরেছবি: প্রথম আলো।

হানিফ ব্যাপারীর কাছে বয়স জানতে চাইলে জবাবে বললেন, ৬৬। বয়সের ভারে শারীরিক অসুস্থতা এখন তাঁর নিত্যসঙ্গী। বয়স আর অসুস্থতার বাধাকে পাশ কাটিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বাদাম বিক্রি করছেন তিনি। টানা ২০ বছর ধরে বাদাম বিক্রির টাকায় সংসার চালাচ্ছেন। কারও দয়া বা ভিক্ষা নিতে চান না। তাই এখনো কর্মচঞ্চল দিন কাটে তাঁর।

হানিফ ব্যাপারীর বাড়ি চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার উত্তর দিঘলদী গ্রামে। স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তাঁর সংসার। ২০০৪ সাল থেকে উপজেলা সদরের কলেজগেট এলাকায় ফুটপাতে ভ্যানগাড়িতে করে বাদাম ভেজে বিক্রি করছেন তিনি।

গতকাল বুধবার বিকেল ৪টার দিকে ওই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভ্রাম্যমাণ ভ্যানগাড়ির পাশে কথা হয় হানিফ ব্যাপারীর সঙ্গে। আলাপচারিতায় উঠে আসে তাঁর কষ্ট, বাঁচার সংগ্রাম, হতাশা ও সমস্যার কথা। তিনি জানালেন, তাঁর নিজের কোনো জমিজমা নেই। দুই ছেলে টুকটাক কাজ করলেও সে টাকায় তাঁদের হাতখরচই চলে না। ফলে সংসারের সব খরচ তাঁকেই বহন করতে হয়।

কথাবার্তার একপর্যায়ে হানিফের মনোযোগ সরে গেল এক ক্রেতার দিকে। তাঁর কাছে বাদাম চাইলেন ওই ক্রেতা। এ সময় একটি চুলায় আগুনে তেতে ওঠা কালচে বালুতে কাঁচা বাদাম ছেড়ে দিলেন তিনি। এরপর পরম যত্ন আর কৌশলে সেগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ভেজে নিলেন। সবশেষে গরম-গরম বাদামগুলো একটি ছোট ঠোঙায় ভরে তুলে দিলেন ক্রেতার হাতে। বিনিময়ে ১০ টাকা পেলেন হানিফ।

প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সময়ে সেখানে বাদাম বিক্রি করেন হানিফ। গতকাল দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

হানিফ বলেন, প্রতিটি ছোট প্যাকেটে ১০ টাকা ও বড় প্যাকেটে ২০ টাকায় খুচরা বাদাম বিক্রি করেন তিনি। উপজেলা সদর বাজার থেকে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা কেজিদরে বাদাম কিনে সেগুলো ভেজে বিক্রি করেন গড়ে ২৫০ টাকায়। প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সময়ে গড়ে ৪ থেকে ৫ কেজি বাদাম বিক্রি করেন তিনি। প্রতি কেজি বাদাম বিক্রি করে লাভ হয় ৮০ থেকে ৯০ টাকা। সেই হিসেবে প্রতিদিনই গড়ে ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা তাঁর লাভ হয়। এর মধ্যে বাকি ও বকেয়াও থাকে। আবহাওয়া খারাপ থাকলে, বৃষ্টিবাদল হলে কিংবা শরীর খারাপ হলে ওই দিন আর বাদাম বিক্রি করেন না।

এখন প্রায়ই অসুস্থতায় ভোগেন হানিফ। তাঁর দাবি, তাঁর হৃদ্‌রোগের পাশাপাশি কিডনিতেও সমস্যা আছে। কাজ করলে শরীর ক্লান্ত ও দুর্বল লাগে। প্রতি মাসে গড়ে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা আয় করেন হানিফ। এ টাকায় পরিবারের ভরণপোষণ ও অন্যান্য খরচ চালাতে হয়। ওষুধপত্র ও কাপড়চোপড় কিনতে হয়। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম চড়া থাকায় এ টাকায় সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। প্রায়ই ধারকর্জ করতে হয়। তাঁর ভাষায়, ‘বাদাম বেইচ্চা যা পাই, তা দিয়া ঠিকমতো সংসার চলে না।’

হানিফ ব্যাপারীকে পরিশ্রমী ও লড়াকু উল্লেখ করে উপজেলার মতলব সরকারি কলেজের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক তৌহিদুল আলম ও মো. কামাল হোসেন বলেন, ওই বাদাম বিক্রেতা পরিশ্রমী ও লড়াকু মানুষ। সমাজের দৃষ্টান্ত।