৩৮ কোটি টাকার বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন শুধুই দেখার জিনিস
কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়ার মানুষকে বিদ্যুৎ–সুবিধা দিতে দুটি প্রকল্পের অধীন ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছিল বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র। একটি প্রকল্প ২০০৭ সালে ও অপরটি ২০১৬ সালে চালু হয়। দুই প্রকল্পের অধীন বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য স্থাপন করা হয় ৭০টি হাওয়াকল। বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম প্রকল্পের অধীন স্থাপন করা হাওয়াকল থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা গেছে মাত্র কয়েক দিন। দ্বিতীয় দফায় চালু করা হওয়াকল সক্রিয় ছিল কয়েক মাস। এর পর থেকেই বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের হাওয়াকলগুলো কেবল দেখার জিনিসে পরিণত হয়েছে। এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের পুরো টাকাই প্রকৃতপক্ষে অপচয় হয়েছে। এটি এখন তাঁদের বোঝা।
সরকারি কোষাগারের মূল্যবান টাকা খরচ করে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হলেও জাতীয় তথ্য বাতায়নে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের এলাকাটিকে দর্শনীয় স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের তাবলেরচর এলাকার পশ্চিম সৈকতে ২০০৭ সালে ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ১ হাজার কিলোওয়াট (১ মেগাওয়াট) উৎপাদন ক্ষমতার বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কেন্দ্রের দুই পাশে খোলা জায়গায় স্থাপন করা হয় ৫০ ফুট উঁচু ৫০টি বায়ুকল। মাথায় লাগানো হয় ইস্পাতের উইন্ড টারবাইন বা বায়ুচালিত পাখা। বাতাসে পাখা ঘুরলে উৎপাদিত হয় বিদ্যুৎ। সেই বিদ্যুৎ ব্যাটারিতে জমা করে গ্রাহকের কাছে সরবরাহের কথা।
২০০৮ সালের ১৫ মার্চ কেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়। এরপর ১৪ এপ্রিল ৬০০ গ্রাহকের মধ্যে সান্ধ্যকালীন কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। কিন্তু কয়েক দিনের মাথায় কেন্দ্রের একটি যন্ত্র অচল হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০১০ সালের ১৪ জুলাই ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে থাকা বেড়িবাঁধ ভেঙে গেলে কেন্দ্রটি ঝুঁকির মুখে পড়ে। গত ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বছরে কেন্দ্রটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
এদিকে ২০১৬ সালে অচল হয়ে পড়া বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে ১ মেগাওয়াটের আরেকটি নতুন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। তাতে খরচ হয় ২৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের ১৫ মার্চ কেন্দ্রটি চালু হয়। ৩৫০ জন গ্রাহকের কাছে সন্ধ্যাকালীন কয়েক ঘণ্টার বিদ্যুৎ সরবরাহও শুরু হয়। কিন্তু এক মাস যেতে না যেতেই এটিও অচল হয়ে পড়ে। ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত ৬ বছরে এই কেন্দ্রও আর আলোর মুখ দেখেনি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বাসিন্দারা বলেন, দুর্নীতি-লুটপাটের জন্যই দুর্গম উপকূলে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এ জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। কেন্দ্র দুটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
পরিত্যক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র
১২ ও ১৩ নভেম্বর কুতুবদিয়ায় গিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেহাল দশা চোখে পড়ে। দুই বছর আগে শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বেড়িবাঁধের বিভিন্ন অংশ ভেঙে গেছে। বাঁধের পাশে পড়ে আছে দোতলা একটি ভবন, যার ভেতরে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যালয়, উৎপাদিত বিদ্যুৎ ধারণের ১ হাজার ব্যাটারি ও মূল্যবান যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়। ভবনের দুই পাশে (উত্তর-দক্ষিণ) বেড়িবাঁধের পাশে খোলা জায়গায় স্থাপিত ৫০টি বায়ুকলে মরিচা ধরেছে। খুঁটির মাথায় বাঁধা ইস্পাতের উইন্ড টারবাইনগুলো ভেঙে পড়েছে। অধিকাংশ খুঁটি হেলে পড়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহের তার নেই। পরিত্যক্ত দোতলা ভবনের ভেতরে কাউকে পাওয়া গেল না। ভবনের ভেতরে থাকা ব্যাটারি, মূল্যবান যন্ত্রপাতি চুরি হয়েছে বলে জানান স্থানীয় জেলেরা।
দ্বিতীয় দফায় নির্মিত বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রেরও একই অবস্থা। ভবনটির গেটে তালা ঝুলছে। লোনা হাওয়ায় বায়ুকলগুলোয় মরিচা ধরেছে। খুঁটির মাথায় বাঁধা পাখাগুলো ভেঙে পড়ছে। কাঁটাতারের সীমানাও উধাও হচ্ছে। কেন্দ্রের অরক্ষিত জমিতে চলছে লবণ উৎপাদন। প্রকল্পের যন্ত্রপাতি চুরি হচ্ছে কি না, তা দেখার কেউ সেখানে নেই।
ঢাকার বকশি বাজার থেকে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র দেখতে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই শিক্ষার্থী মনছুর আলম ও একরামুল হক। মুঠোফোনে কেন্দ্রের ভিডিও চিত্র ধারণ করছিলেন দুজন। পরিত্যক্ত ভবনের ভেতর থেকে ঘুরে এসে ক্ষুব্ধ পতিক্রিয়া ব্যক্ত করে দুই শিক্ষার্থী বলেন, এভাবে সরকারি টাকা লুটপাটের কোনো মানে হয় না। অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হয়ে গেছে সরকারি প্রকল্পটি।
আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফিরোজ খান বলেন, দুর্নীতি, তদারকির অভাব এবং স্থান নির্বাচনে অদূরদর্শিতার কারণে বিদ্যুৎ প্রকল্পটি রক্ষা করা যায়নি। বাইরের মানুষের কাছে কেন্দ্রটি বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেলেও এটি আলী আকবর ডেইলবাসীর কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পিডিবি কুতুবদিয়া আবাসিক প্রকৌশলী সুভাষ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ২ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি এখন পরিত্যক্ত। কেন্দ্র দেখাশোনার লোকবলও নেই। কেন্দ্র দুটি পিডিবির কাছেও হস্তান্তর করা হয়নি। খোলা মাঠে পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিছু লোক কেন্দ্র দেখতে আসেন, হতাশ হয়ে আবার ফিরে যাচ্ছেন।
৫২ বছর পর জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ
উপজেলা পরিষদ সূত্র জানায়, এ উপজেলায় ১৯৮০ সালে জেনারেটরের মাধ্যমে প্রায় ৬০০ গ্রাহকের মধ্যে সান্ধ্যকালীন কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে গেলে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। পিডিবি ২০০৫ সালে দেড় কিলোমিটার লাইন মেরামত করে দুটি জেনারেটরের মাধ্যমে সন্ধ্যার পর কয়েক ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।
জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সাবমেরিন কেব্লের মাধ্যমে পেকুয়া থেকে কুতুবদিয়ায় জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ-সংযোগ নিশ্চিত করে। ২০২৩ সালের ১৪ এপ্রিল বিদ্যুৎ–সংযোগের উদ্বোধন করা হয়।
পিডিবি কুতুবদিয়া আবাসিক প্রকৌশলী সুভাষ চৌধুরী বলেন, ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত কুতুবদিয়ায় ৯ হাজার ৭০০ গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। বিদ্যুতের চাহিদা ২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট। শতভাগ বিদ্যুৎ বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে উপজেলায় লোডশেডিং হচ্ছে না। দ্বীপের বর্তমান লোকসংখ্যা ১ লাখ ৫১ হাজার।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও হোটেলমালিক আদিল চৌধুরী বলেন, জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ দ্বীপের চেহারা পাল্টে দিচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় এত দিন চাষাবাদ, পোলট্রি, মৎস্য খামার, শিল্প-কলকারখানা, কুটিরশিল্প গড়ে ওঠেনি। একমাত্র ৫০ শয্যার সরকারি হাসপাতাল চলত জেনারেটর চালিয়ে। এখন দ্বীপে উৎপাদিত সামুদ্রিক মাছ, শুঁটকি, লবণ, তরমুজসহ নানা কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন মানুষ। বায়ুবিদ্যুতের আর প্রয়োজন নেই।