গরু বিক্রিচেষ্টার ক্ষোভেই দুই ছেলে নিয়ে নদে মায়ের ঝাঁপ
স্বামীর অলসতা আর পাশাপাশি জুয়ার আড্ডায় আসা-যাওয়া নিয়ে নাসিমা বেগমের দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। এই দুশ্চিন্তার মধ্যেই দুই ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন সাজিয়েছিলেন তিনি। স্বামীর স্বভাবের কথা ভেবে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সম্মতিতে নিজের গরুগুলো বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন নাসিমা। হাতে টাকা না থাকায় সেই গরু ফিরিয়ে এনে বিক্রি করতে পীড়াপীড়ি শুরু করেন নাসিমার স্বামী আবদুর রহিম।
নাসিমা কিছুতেই গরুগুলো বিক্রি করতে চাইছিলেন না। কিন্তু রহিম কোনো প্রকার ছাড় দিতে নারাজ। এ নিয়ে নাসিমার সঙ্গে তাঁর ঝগড়াবিবাদও হয়। এসব অগ্রাহ্য করে শ্বশুরবাড়ি থেকে গরু আনতে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান রহিম। এই ক্ষোভেই দুই ছেলে নিয়ে ভরা নদে ঝাঁপ দেন তিনি। ঝাঁপ দেওয়ার আগে নিজের পরনের ওড়নায় ছেলেদের হাত নিজের হাতে বেঁধে নেন। ঝাঁপ দেওয়ার পরই প্রবল স্রোতে তাঁরা মুহূর্তে তলিয়ে যান।
গতকাল বুধবার সকালে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের কাশীডাঙ্গা গ্রামের তীরনই নদ থেকে রহিমের স্ত্রী নাসিমা (৩৫) ও তাঁর দুই ছেলে শাওন (৮) আর সাফায়াত ওরফে সিফাতের (৪) লাশ উদ্ধার করা হয়। গতকাল দিবাগত রাতেই তাঁদের দাফন করা হয়।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রানীশংকৈল উপজেলার কলন্দা পশ্চিমপাড়ায় নাসিমার বাবার বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, তাঁর স্বজনেরা বাড়ির বারান্দায় বসে আছেন। সবার মধ্যে উদাসীনতা। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন তাঁরা। জড়ো হলেন প্রতিবেশীরাও। সে সময় ছুটে আসেন নাসিমার ভাবি খাদিজা বেগম। তিনি বলেন, ‘নিজেই কোলেপিঠে করে নাসিমাকে বড় করেছি। কিছুতেই ভুলতে পারব না।’ বলতে বলতে কণ্ঠ ধরে আসে তাঁর। এরপর উচ্চস্বরে কেঁদে ওঠেন। পাশে থেকে নাসিমার ছোট বোন লাবণী আক্তার এসে ভাবিকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
লাবণী বলেন, ‘ছেলে দুইটার মুখের দিকে চেয়ে আমার বোন বেঁচে ছিল। সেই সন্তানকে নিয়ে আত্মহত্যা করবে, বিশ্বাস করার মতো না।’
নাসিমার বড় ভাই ফারুক আজম বলেন, ২০১৪ সালে নাসিমার সঙ্গে কাশীডাঙ্গা গ্রামের রহিমের বিয়ে হয়। তাঁদের সংসারে দুটি ছেলেসন্তান জন্ম নেয়। ব্যক্তিগত জীবনে রহিম একটু অলস প্রকৃতির। সেভাবে কাজকর্ম করতে চাইতেন না। পাশাপাশি এলাকার জুয়ার আড্ডায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এ নিয়ে নাসিমা একবার ছেলেদের নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসে। শেষে ছেলেদের কথা ভেবেই আবার ফিরে যায়। যাওয়ার সময় সে বলে যায়, ছেলে দুইটা বড় হলেই তাঁর আর কিছু লাগবে না। বড় না হওয়া পর্যন্ত এভাবে আর এখানে আসবে না।
ফারুক আজম আরও বলেন, ‘নাসিমা বাবার বাড়িতে এল, তবে জীবিত নয়, লাশ হয়ে। এটা আত্মহত্যা নয়, হত্যাকাণ্ড।’ তাঁর দাবি, শ্বশুরবাড়ির লোকজন নাসিমা ও তাঁর ছেলেদের হত্যা করে পরে নদের পানিতে ফেলে দেয়। তা না হলে রাতভর কয়েক শ মানুষ তল্লাশি করেও তাঁদের খুঁজে পাওয়া গেল না কেন? এ ছাড়া লাশ উদ্ধারের পর কারও পেটে পানিও ছিল না।
ফারুকের ছেলে রায়হান কবির জানাল, ময়নাতদন্তের পর গতকাল রাতেই ফুফুর লাশ এখানে (নাসিমার বাবার বাড়ি) আর ফুফাতো ভাইদের তাদের দাদার বাড়ি কাশীডাঙ্গা গ্রামে দাফন করা হয়।
কলন্দা পশ্চিম পাড়া থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে নাসিমার শ্বশুরবাড়ি। সেখানে গিয়ে নাসিমার স্বামী রহিমকে পাওয়া গেল না। বাড়ির লোকজনকে স্বাভাবিক মনে হলো। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। পরিচয় পেয়ে বাড়ির লোকজন জানালেন, তিনি কবরস্থানে গেছেন। সে সময় কথা প্রসঙ্গে রহিমের বড় ভাবি বাবলি আক্তার বলেন, ‘নাসিমা নরম স্বভাবের ছিল। কারও সাথত ওর ঝগড়া ছিল না। নাসিমা মনে করছিল রহিম গরুলা আনিলেই বেচে খায়ে ফিলাবে। গরু আনিবারতানে রহিম বের হওয়ায় নাসিমা এই কাজখান করিছে।’ তবে রহিম জুয়া আসরে যেতেন, এ অভিযোগ মানতে নারাজ বাবলি।
রহিমদের বাড়ি থেকে তীরনই নদ প্রায় ৭০০ মিটার দূরে। সেই নদের ধারের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে নাসিমার ছেলে শাওন আর সাফায়েতকে। সেখানে রহিমকে পাওয়া না গেলেও তাঁর বাবা শামসুল হককে পাওয়া গেল। তিনি তাঁর ছেলে জাহাঙ্গীরকে নিয়ে নাতিদের কবরের বেড়া তৈরি করছিলেন। সে সময় শামসুল বললেন, ‘বাড়িত তো কোনো ঝামেলা ছিল না। নাতিলাক বাঁচাবা গিয়ে বউমা নিজেও ডুবে যাবার পায়।’
তাহলে সবার হাত বাঁধা ছিল কেন? এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারলেন না তিনি।
তবে গ্রামের বাসিন্দা জহুরুল ইসলাম বললেন, ‘এলাকায় জুয়ার আসর আর নেশার আড্ডা বসে। জুয়ার আসরে রহিমকে দেখা যেত। তবে সে নেশা করত কি না, জানা নেই। গরু বিক্রি করে রহিম হয়তো জুয়ার টাকা জোগাড় করতে চাইছিল। আর সেটা মানতে পারেনি নাসিমা। এই জুয়ার জন্যই একটি পরিবারের তিনটি জীবন শেষ হয়ে গেল।’
রানীশংকৈল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গুলফামুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, নদ থেকে মা ও দুই ছেলের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে আসল ঘটনা জানা যাবে।