দালালের মাধ্যমে সৌদি আরবে গিয়ে প্রতারণার শিকার ৯ ব্যক্তি, ঋণের চাপে দিশাহারা পরিবার
দালাল ধরে সৌদি আরবে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ৯ ব্যক্তি। দুই বছর আগে সৌদি আরবে গেলেও আকামা (কাজের অনুমতিপত্র) না পাওয়ায় কর্মহীনভাবে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাঁদের। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় দেশেও ফিরতে পারছেন না তাঁরা। পরিবারকে টানতে হচ্ছে ঋণের বোঝা। কোনো কোনো পরিবার ঋণের ফাঁদে আটকে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে।
স্বজনদের অভিযোগ, উপজেলার ধারাবারিষা ইউনিয়নের খাকড়াদহ পূর্বপাড়া গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম নামে এক ব্যক্তি দীর্ঘ বছর ধরে সৌদি আরবে থাকেন। তাঁর মাধ্যমে একই গ্রামের মিজানুর রহমান, সাইফুল ইসলাম, সোহাগ মোল্লা, মাজিদুল মোল্লা, সাজেদুল ইসলাম ও মন্তাজ আলী এবং তাড়াশিপাড়া গ্রামের সমশের আলী, হাঁসমারী গ্রামের এনামুল ইসলাম ও নাজিরপুর ইউনিয়নের বেড়গঙ্গারামপুর গ্রামের মতিউর রহমান সৌদি আরবে যান।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সৌদি আরবে নেওয়ার আগে ভালো বেতন ও সুযোগ–সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। তাঁদের অভিযোগ, বিষয়টি নিয়ে অভিযুক্ত জাহাঙ্গীর আলমের পরিবারের সঙ্গে কয়েক দফা সালিসে বসলেও কোনো কাজ হয়নি। প্রতিকার পেতে গতকাল পর্যন্ত ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে ৯টি অভিযোগ দিলেও থানা পুলিশ সেগুলো আমলে নিচ্ছে না। নিরুপায় হয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা সাংবাদিক সম্মেলন ও মানববন্ধন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন।
গতকাল ধারাবারিষা ইউনিয়নের চরকাদহ পূর্ব পাড়া গ্রামে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন প্রবাসে থাকা ব্যক্তিদের স্ত্রী-সন্তান, মা–বাবাসহ সাধারণ মানুষ। সেখানে উপস্থিত ছিলেন গ্রামপ্রধান আবু হানিফ। তিনি বলেন, সৌদিতে যাওয়া ব্যক্তিরা অশিক্ষিত ও শ্রমজীবী মানুষ। সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য এবং সংসারে সুখ ফেরাতে কৃষিজমি ও ভিটেমাটি বন্ধক রেখে, ঋণ নিয়ে টাকার ব্যবস্থা করেছেন তাঁরা। কিন্তু দুই বছর পার হলেও তাঁরা বিদেশ থেকে কোনো টাকা পরিবারের কাছে পাঠাতে পারেননি। ঋণের দায়ে কোনো কোনো পরিবারের লোকজন এলাকাছাড়া, অনেকে আবার ঋণের বোঝা টেনেই চলেছেন।
আবু হানিফ আরও জানান, শেষ গত সপ্তাহে জাহাঙ্গীর আলম সৌদি আরব থেকে গ্রামে ফিরলে ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা তাঁর বাড়িতে গিয়ে চড়াও হন। পরে জাহাঙ্গীর আলম ও তাঁর পরিবারের লোকদের নিয়ে গত রোববার রাতে গ্রামে সালিস বসে। বৈঠক থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রত্যেক পরিবারকে এক লাখ টাকা ফেরত দেওয়ার রায় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জাহাঙ্গীর আলম ওই রায় আমলে নেননি।
ভুক্তভোগী এনামুল ইসলামের স্ত্রী আজেদা বেগম বলেন, ব্যাটারিচালিত ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতেন তাঁর স্বামী। ভবিষ্যৎ ও সংসারের সুখের আশায় বিদেশে যেতে বসবাসের দুই কাঠা ভিটা বন্ধক রেখে দুই বছর আগে জাহাঙ্গীর আলমের হাতে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিলেন তাঁর স্বামী। এরপর এনামুলকে সৌদি আরবে পাঠানো হলেও তিনি মূলত প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এনামুল দুই বছরে কোনো টাকা পাঠাতে পারেননি। সময়মতো বন্ধকের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় বসবাসের ভিটেমাটি দখলে নিয়েছেন লগ্নিকারী ব্যক্তি। এমন অবস্থায় নিরুপায় হয়ে সড়কের পাশের পরিত্যক্ত জায়গায় ঝুপরি তুলে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে অমানবিক জীবন যাপন করতে হচ্ছে আজেদা বেগমকে।
সোহাগ মোল্লার স্ত্রী রুপালি খাতুন বলেন, এক বিঘা কৃষিজমি লিজ দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলমের হাতে। এ টাকার বিপরীতে বছরে ২৫ হাজার টাকা লাভ গুনতে হচ্ছে। সংসারে আয় না থাকায় বিভিন্ন এনজিও থেকে পর্যায়ক্রমে আরও পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। এখন ১০ লাখ টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন রুপালি। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে অকুলপাথারে পড়েছেন তিনি। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় স্বামী দেশে ফিরতে পারছেন না বলেও জানান রুপালি।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্য নেওয়ার জন্য তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর স্ত্রী রওশন আরা বলেন, সৌদিতে পাঠানো ব্যক্তিদের পরিবারের লোকজনের কারণে তাঁর স্বামী ঠিকমতো বাড়িতে থাকতে পারছেন না। স্বামীর উদ্ধৃতি দিয়ে রওশন আরা আরও বলেন, মাত্র চার থেকে পাঁচ লাখ টাকায় তাঁদের সৌদিতে নেওয়া হয়েছে। আকামার জন্য বাড়তি টাকা না দেওয়ায় সে দেশে বৈধভাবে কাজ করতে পারছেন না, এটা ঠিক। তবে সে দেশে সবাইকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করছেন তাঁর স্বামী।
গুরুদাসপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনোয়ারুজ্জামানের সঙ্গে আজ মঙ্গলবার দুপুরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, অভিযোগকারীদের স্বামীরা কেউই বৈধভাবে বিদেশে যাননি। এ কারণে ওই টাকা তুলে দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের নেই।