উপকূলে কৃত্রিম খাদ্যে কোরাল মাছ চাষে আগ্রহ বাড়ছে চাষিদের
আনোয়ার হোসেনের ৩০ শতকের পুকুরটি সারা বছর পতিত পড়ে থাকত। লবণাক্ততার কারণে মাছ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। সেই পতিত পুকুরে কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে কোরাল মাছ চাষ করে সফলতা পেয়েছেন আনোয়ার। এক বছরেই পাঁচ গ্রাম ওজনের কোরালের পোনা দুই থেকে সাড়ে তিন কেজি ওজনের হয়েছে।
আনোয়ার হোসেনের (৫৫) বাড়ি পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের মাইটভাঙ্গা গ্রামে। কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে কোরাল মাছ চাষে তাঁর সফলতা দেখে এলাকার অন্য মাছচাষিদের মধ্যেও আগ্রহ বেড়েছে। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের শিক্ষকেরা গবেষণা করে উপকূলীয় এলাকায় কৃত্রিম খাদ্যে কোরাল মাছ চাষের সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করেন।
গত বুধবার আনোয়ার হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানালেন, লবণাক্ততার কারণে পুকুরটি মাছ চাষের আওতায় আনা যায়নি। এক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পরীক্ষামূলকভাবে তাঁর পুকুরে কোরাল মাছ চাষের কথা বললে রাজি হয়ে যান। পুকুরে মোট ৭০০ পোনা ছাড়া হয়। তিনি বলেন, এ অঞ্চলের কিছু ঘেরে কোরাল মাছ চাষ হলেও খাদ্য হিসেবে ছোট মাছ দেওয়া হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাঁদের খাবার দেওয়ার কথা বললে তিনি বাজার থেকে মাছের খাবার কিনে পুকুরে ব্যবহার করেন। এতে এক বছরে মাছের ওজন দুই থেকে সাড়ে তিন কেজি হয়েছে।
আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিনই এলাকার অন্য মাছচাষিরা তাঁর পুকুরের মাছ দেখতে আসছেন। অনেকে পরামর্শ নিচ্ছেন। ব্যবসার জন্য যদি কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে কোরাল মাছ চাষ করা যায়, তাহলে চাষিরা আর্থিকভাবে অনেক লাভবান হবেন।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ‘বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে কোরাল মাছ চাষ’ শীর্ষক গবেষণা প্রকল্পটি কলাপাড়ার আলীপুরের মাটিভাঙ্গা গ্রামে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগ। অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক প্রধান গবেষক ও ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আরিফুর রহমান সহকারী প্রধান গবেষক হিসেবে কাজ করেন। সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতায় এতে অর্থসহায়তা দেয় মৎস্য অধিদপ্তর।
আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকার ঘেরে দীর্ঘদিন ধরে কোরাল মাছ চাষ হয়ে আসছে। সেখানে কোরালের খাবার হিসেবে তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন ছোট মাছ ব্যবহার করা হয়। কৃত্রিম খাদ্যের অভাবে কোরাল মাছের চাষাবাদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। এ জন্য আগ্রহ বাড়াতে মাছচাষিদের মধ্যে কৃত্রিম খাদ্যে কোরাল মাছ চাষের সব উপকরণ সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি ২৫০ চাষিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, দেশে কোরাল মাছের হ্যাচারি না থাকায় গবেষণাকাজে থাইল্যান্ডের হ্যাচারিতে উৎপাদিত কোরাল মাছের পোনা সংগ্রহ করে নার্সারি পুকুরে নার্সিং করার পর পুকুরে মজুত করা হয়। কোরাল মাছ মাংসাশী হওয়ায় নার্সারি পুকুরে মাঝেমধ্যে জাল টেনে বেশি বড় পোনাকে আলাদা করা হয়েছে।’
প্রধান গবেষক মুহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশে এই প্রথম সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের হ্যাচারিতে উৎপাদিত কোরাল মাছের চাষপদ্ধতি নিয়ে তাঁর দল কাজ করেছে। ৫ গ্রাম ওজনের কোরাল এক বছরে চাষ করে দুই থেকে সাড়ে তিন কেজি ওজনের হয়েছে। এর মাধ্যমে শুধু দক্ষিণাঞ্চল নয়, সারা দেশের উপকূলীয় এলাকার চাষিদের মধ্যে নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার সৃষ্টি হয়েছে। তাঁদের উদ্ভাবিত সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাদ্যে কোরাল মাছের প্রযুক্তি বাংলাদেশে কোরাল মাছের উৎপাদনসহ মৎস্য সম্পদের উৎপাদন বাড়াতে ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।