যেভাবে বদলে যাচ্ছে তাপসীদের জীবন
দক্ষিণ মোহরা বা কালুরঘাট জেলেপাড়ার বাসিন্দা তাপসী দাস। তাঁর ছেলে সামান্য একটা চাকরি করেন। তাঁদের কাঁচা ঘরটি প্রতিবার বর্ষা এলেই পানিতে তলিয়ে যেত। বেড়া ভেঙে যেত। এক বছর ধরে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। প্রমত্ত কর্ণফুলীর পাড়ে দেওয়া একটি প্রতিরক্ষাদেয়াল জেলেপাড়াটির দেড় হাজারের বেশি বাসিন্দাকে রক্ষা করেছে। এতে তাঁরা খুশি।
এই বাঁধ করার পেছনে নিজেদের শ্রম রয়েছে। তবে সার্বিক সহযোগিতায় আছে উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপি। শুধু তা–ই নয়, বাঁধের পাশের পথটিও পাকা হয়েছে। ফেলে দেওয়া পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহার করে একটা ফুটপাত এবং গণশৌচাগারও করা হয়েছে পাড়াটিতে। মোহরার মতো চট্টগ্রাম নগরের ২৪টি ওয়ার্ডে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে ইউএনডিপি। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির শিকার শহুরে দরিদ্র লোকজনের জীবনমানের উন্নয়নে সহায়তা দিচ্ছে এই সংস্থা। এ জন্য লাইভলিহুড ইমপ্রুভমেন্ট অব আরবান পুওর কমিউনিটিস(এলআইইউপিসি) নামের একটি প্রকল্পও হাতে নিয়েছে। এলআইইউপিসি প্রকল্পের অধীনে চট্টগ্রামের পাশাপাশি কক্সবাজারে ১২ ওয়ার্ডেও একই ধরনের প্রকল্প চলছে। প্রকল্পের অধীনে রাস্তা তৈরি, বাঁধ নির্মাণ, নালা, শৌচাগার, সড়কবাতি তৈরি, বৃক্ষরোপণ, গৃহ নির্মাণ, পুষ্টি, সেলাই প্রশিক্ষণ, শিক্ষা সহায়তাসহ নানা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় দুই হাজার বাসিন্দার জীবনযাত্রা বদলে গেছে একটি প্রতিরোধদেয়াল ও সেতুর কল্যাণে। শুধু তা–ই নয়, গৃহ নির্মাণ, ব্যবসায় সহায়তা, পুষ্টি, সেলাই প্রশিক্ষণ, শিক্ষা সহায়তাসহ নানা কাজে সম্পৃক্ত এখানকার বাসিন্দারা।
চট্টগ্রাম নগরের ৫ নম্বর মোহরা ওয়ার্ডের দক্ষিণ মোহরা জেলেপাড়া এলাকায় প্রায় ১ হাজার ৬০০ লোকের বসবাস। এখানকার বেশির ভাগের পেশা কর্ণফুলী নদীতে মাছধরা। মাছ ধরে আশপাশের বাজারে বিক্রি করে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু কর্ণফুলী নদীর ভাঙনে তাঁদের চলাচলের পথ বারবার ভেঙে যেত। ১১৫ মিটার দৈর্ঘ্যের একটা প্রতিরক্ষাদেয়াল পাল্টে দিয়েছে পাড়াটির চিত্র।
প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের ৮ হাজার ৭৯১ জনকে ব্যবসা খাতে সাহায্য করা হয়েছে। এ ছাড়া ৬ হাজার ৯৭১ জনকে শিক্ষাসহায়তা, ৪ হাজার ৭২৪ জন অন্তঃসত্ত্বা নারী ও মায়ের পুষ্টিমান উন্নয়নে সাহায্য করা হয়। এ ছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্যে ৭৬৭টি শৌচাগার করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৪ কিলোমিটার ফুটপাত নির্মাণ, ৭২টি গভীর নলকূপ স্থাপন, প্রায় চার কিলোমিটার নালা নির্মাণ এবং নালার ওপর ৩ দশমিক ৭ কিলোমিটার স্ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে।
মোহরা সিডিসির দলপ্রধান শিল্পী দাশ বলেন, ‘প্রকল্পের অধীনে আমাদের মতো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন যেমন করতে পেরেছি, তেমনি অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। বাল্যবিবাহ রোধ করা গেছে। কয়েকজনকে ঘর নির্মাণের টাকাও দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে কক্সবাজারে ২৫০ জনকে ব্যবসা–সহায়তা, বাল্যবিবাহ রোধে শিক্ষাসহায়তা দেওয়া হয় ১৯০ জনকে। পুষ্টিসহায়তা পেয়েছেন ৮০০ অন্তঃসত্ত্বা নারী ও মা। এ ছাড়া সহায়তা নিয়ে যৌথ ব্যবসার মাধ্যমে ২৯ পরিবার নিজেদের অবস্থান উন্নতি করেছে।
কক্সবাজারে স্থাপন করা হয়েছে ২১টি গভীর নলকূপ। প্রায় তিন কিলোমিটার নালা এবং আড়াই কিলোমিটার নালার ওপর স্ল্যাব নির্মাণ করা হয়। ১৩৭ মিটার আরসিসি সড়ক, ২৬৫ মিটার ইট ও আরসিসি সড়ক করা হয়।
কক্সবাজার সমিতি পাড়া এলাকাটি একসময় বর্ষাকালে পানিতে তলিয়ে যেত। এরপর ১৯৯১ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর কুতুবদিয়া থেকে গৃহহীন মানুষ এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। পর্যায়ক্রমে তারা সেখানে বসতি গড়ে তোলে। কিন্তু প্রতি বর্ষায় তাদের দুর্দশার অন্ত ছিল না বলে জানান বাসিন্দা রিনা আকতার। তিনি বলেন, এই পাড়া থেকে ওই পাড়া তখন নৌকা নিয়ে পার হতে হতো। ইউএনডিপি পাকা সড়ক করে দেওয়ার পর এখন সেই দুর্দশা লাঘব হয়েছে।
যুক্তরাজ্য সরকারের সহায়তায়, এলআইইউপিসি প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের ১৯টি জেলার শহরাঞ্চলের প্রায় ৪০ লাখ জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ মানুষকে সেবার আওতায় এনেছে ইউএনডিপি। জানতে চাইলে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার বলেন, ‘প্রকল্পটি ৫০ হাজারের বেশি নারীকে জীবিকাসংক্রান্ত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতায়িত করেছে। ২০ হাজার ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষাসংক্রান্ত সহায়তা দিয়েছে, কার্যকরভাবে বাল্যবিবাহ এবং শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া প্রতিরোধ করেছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের অন্তর্ভুক্তিও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে।’
স্টেফান লিলার আরও বলেন, প্রকল্প এলাকায় প্রায় ২৪ হাজার কমিউনিটি অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। যার উপকারভোগী হবে প্রায় ১৮ লাখ মানুষ, জলবায়ুগত ঝুঁকি মোকাবিলায় যাদের সহনশীলতা বৃদ্ধি পাবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে।