মৌলভীবাজারের লোকালয়ে ঢুকছে মনু নদের পানি
মৌলভীবাজারের রাজনগরে মনু নদ প্রকল্প বাঁধের একাধিক স্থান ভেঙে গেছে। অনেক স্থানে বাঁধ উপচে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে উপজেলার লোকালয়ে ঢুকছে মনু নদের পানি। ফসলের মাঠ ডুবছে। বাড়িঘরে পানি উঠছে। মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কের একাধিক স্থান পানিতে তলিয়ে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে রাজনগর উপজেলার মুনসুরনগর ইউনিয়নের কদমহাটা এলাকায় পানি উপচে মনু নদ প্রকল্পের বাঁধের একটি স্থান ভেঙে যায়। একই এলাকায় পাশাপাশি আরও তিনটি স্থান দিয়ে পানি উপচে বের হচ্ছে। অন্যদিকে মনু নদে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মৌলভীবাজার শহরের মানুষ গতকাল বুধবার রাতটি বন্যার আতঙ্কে নির্ঘুম কাটিয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, গতকাল রাতে রাজনগর উপজেলার শ্বাসমহল এলাকায় মনু সেকেন্ডারি বাঁধ (নদসংলগ্ন বাঁধ) ভেঙে সেকেন্ডারি বাঁধ ও মনু নদ প্রকল্প বাঁধের মধ্যবর্তী গ্রামের লোকালয়ে পানি ঢোকে। রাতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় সব ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। এ সময় যে যা পেরেছেন, সঙ্গে নিয়ে ঘর ছেড়েছেন। অনেকেই কদমহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কদমহাটা উচ্চবিদ্যালয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গেছেন।
এদিকে সকালের দিকে কদমহাটায় বাঁধের একটি স্থান ভেঙে গেছে। এতে রাজনগর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। এই পানি গিয়ে নামছে কাউয়াদিঘি হাওরে। কাউয়াদিঘি হাওরপারের সব কটি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে পড়বে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
কদমহাটার বন্যাকবলিত জেলি বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাত তিনটার দিকে ঘরে পানি ঢুকছে। পানি এরপর আর সময় দিছে না। তুরাতুরি (অল্পকিছু) যা পারছি, লইয়া বাইর অইছি (নিয়ে বের হয়েছি)। এখন অন্য জায়গায় উঠছি।’
সকাল সাতটার দিকে কদমহাটা গিয়ে দেখা গেছে, সকাল থেকেই কদমহাটা বাজারের পূর্ব দিকে মনু প্রকল্প বাঁধের অন্তত চারটি স্থান দিয়ে পানি উপচে বের হচ্ছে। দ্রুতগতিতে পানি নামছে। বাঁধের অংশ টুকরা টুকরা হয়ে ধসে পড়ছে। বন্যার আতঙ্কে পানির কাছে ছুটে আসছেন অনেক মানুষ।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, রাতে স্থানীয় লোকজন বালুর বস্তা ফেলে পানি উপচানো বন্ধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মনু নদের পানি দ্রুত বাড়ায় তাঁদের সব চেষ্টা ভেস্তে গেছে। সকাল থেকে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকতে থাকে। একপর্যায়ে তাঁরা হাল ছেড়ে দেন। সকাল সাড়ে আটটার দিকে কদমহাটা বাজারসংলগ্ন পূর্ব দিকে বাঁধের একটি স্থান ভেঙে যায়। এতে হু হু করে পানি ঢুকতে থাকে গ্রামের দিকে। অল্প সময়ের মধ্যে মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কের কদমহাটা এলাকা কয়েক ফুট পানিতে তলিয়ে যায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মৌলভীবাজার কার্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল উপজেলার টেংরা ইউনিয়নের ভাঙারহাটে মনু নদ প্রকল্পের বাঁধের একটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এই ভাঙনের পানি রাজনগর উপজেলা সদরসহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে। মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কের রাজনগর কলেজ এলাকা মনু নদের পানিতে তলিয়ে গেছে।
মনু নদে পানি বাড়া অব্যাহত থাকায় শহরবাসীর মধ্যে বন্যা–আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শহর প্রতিরক্ষা দেয়াল চুইয়ে শহরের এম সাইফুর রহমান সড়কের পশ্চিম বাজারের দিকে পানি ঢুকতে থাকে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মাটির বস্তা ফেলে স্বেচ্ছাশ্রমে শহর প্রতিরক্ষা দেয়াল চুইয়ে শহরের দিকে পানির প্রবেশ বন্ধ করেন। সারা রাত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে যাঁর মতো একে অন্যকে সতর্ক করেছেন। বন্যা–আতঙ্কে শহরের মানুষ অনেকটাই নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন।
উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী জাহেদ আহমদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শহর প্রতিরক্ষা দেয়াল চুইয়ে পানি প্রবেশ বন্ধে স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট, অনেক ক্রিকেটার, অনেক তরুণ, ব্যবসায়ী সহযোগিতা করেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড বস্তা দিয়েছে। সবাই মিলে পানি বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে।’
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, আজ দুপুর ১২টায় মনু নদের পানি রেলওয়ে ব্রিজে বিপৎসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার ও চাঁদনীঘাটে ১১৮ সেন্টিমিটার, ধলাই নদে রেলওয়ে ব্রিজের কাছে ৩০ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা নদী শেরপুরে ৮ সেন্টিমিটার এবং জুড়ীর ভবানীপুরে ১৯৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে দেখা গেছে, মনু নদের রেলওয়ে ব্রিজ ও ধলাই নদের রেলওয়ে ব্রিজের কাছে পানি কিছুটা কমার দিকে। সকাল ৯টায় মনু রেলওয়ে ব্রিজে পানি ছিল ১০৫ সেন্টিমিটার ও ধলাইয়ে ৩২ সেন্টিমিটার ওপরে।
পাউবো মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, সারা রাত মনু নদের পাড়ে কেটেছে। পানি কিছুটা কমেছে। মনুর রেলওয়ে ব্রিজের কাছে পানি কমাটা গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া প্রচুর স্রোত আছে। এতে বোঝা যায়, পানি নিচের দিকে নামছে। উজানে (ভারতের কৈলাশহরে) বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলেও এখন বৃষ্টি বন্ধ আছে। মনু নদের সেকেন্ডারি ও প্রকল্পের পাঁচ স্থানে বাঁধ ভেঙেছে বলে তিনি জানান।
‘বান্ধটা টিকাইতাম পারলাম না, সব ভাসাই নিল’
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের মিয়ারপাড়া এলাকায় মনু নদে পানি বাড়ার পর বাঁধের কিছু স্থান ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামতের কাজে নেমে পড়েন। তিন দিন চেষ্টা চালিয়েও বাঁধের স্থানটি রক্ষা করা যায়নি। গতকাল বুধবার গভীর রাতে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে স্থানটি ভেঙে পড়ে। প্রবল বেগে পানি ঢুকে তলিয়ে যায় আশপাশের বিভিন্ন এলাকা। টিলাগাঁওসহ পাশের পৃথিমপাশা ইউনিয়নের নতুন করে আরও দুটি স্থানে নদের বাঁধ ভেঙে গেছে।
আজ সকাল ১০টার দিকে মিয়ারপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বাঁধের এক পাশ ভেঙে প্রবল বেগে পানি ঢুকছে। আশপাশের বাড়িঘর, ফসলি জমি সব তলিয়ে গেছে। বাঁধের শুকনা স্থানে অনেকে মালামাল ও গবাদিপশু নিয়ে উঠেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘গাঙে পানি বাড়ার পর এইখানে ফাটল দেখা দিল। গাউর সবাই মিলি বান্ধ বাঁচানিত লাগলাম। তিন দিনে অন্তত দুই হাজার বালুর বস্তা ফালাইলাম। পানি আটকানির চেষ্টা করলাম। বান্ধটা টিকাইতাম পারলাম না, সব ভাসাই নিল।’
বাঁধে আশ্রয় নেওয়া কেউ কেউ বাঁশের খুঁটি পুঁতে টিন, পলিথিনের চালার নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। গবাদিপশু বেঁধে রেখেছেন।
মিয়ারপাড়ার বাসিন্দা খোদেজা বেগম (৪৫) বলেন, ‘রাইত ভিজিয়া কোনোমতে জান লইয়া আইছি। হাতের কাছে যা পাইছি, আনছি। অনেক মাল ঘরো রইছে।’ সোলেমান মিয়া নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘বাড়িঘর শেষ, খেত শেষ। অত পানি এর আগে দেখছি না।’
টিলাগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল মালিক মুঠোফোনে বলেন, ‘শুধু আমার ইউনিয়নে মনু নদের বাঁধের তিনটি স্থান ভেঙে গেছে। ১৯টি গ্রাম বন্যাপ্লাবিত। অন্তত সাড়ে আট হাজার মানুষ পানিবন্দী।’
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মহিউদ্দিন বলেন, তাঁরা মিয়ারপাড়া, চকসালন ও শিকড়িয়া এলাকায় মনু নদের ভাঙনকবলিত স্থানগুলো দেখতে যাচ্ছেন। পানিবন্দী লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরানো হবে। দুর্গত মানুষকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণসহায়তা অব্যাহত আছে।