কারও চোখে টলমল জল। কেউ বা কষ্টে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্না থামানোর চেষ্টায় রত। জটলা থেকে একটু দূরে, এক কোনায় দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছছেন কয়েকজন। মাঝবয়সী লোকটির মুখের এক কোণে আটকে আছে কষ্টের চিহ্ন।
মাঠের অন্য প্রান্তের দৃশ্যটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চলছে আনন্দ-উল্লাস, হইচই। অভিভাবকেরাও শামিল হয়েছেন সন্তানদের সেই উদ্যাপনে।
ঘটনাগুলো বরিশাল জিলা পুলিশ লাইনসের। দাবা খেলাকে কেন্দ্র করেই ঘটেছিল এসব হাসি-কান্নার দৃশ্য। ‘মার্কস অ্যাকটিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’ উপলক্ষে খুদে দাবাড়ুদের মন ভালো রাখার এই অন্য রকম আয়োজন দেশব্যাপী চলছে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের তত্ত্বাবধানে এবং আবুল খায়ের গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায়।
ভারতের কিংবদন্তিতুল্য দাবাড়ু বিশ্বনাথন আনন্দ কিংবা বাংলাদেশের রিফাত বিন সাত্তারের মতো হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে হাজারের অধিক খুদে দাবাড়ু হাজির হয়েছিল ধান-নদী-খাল—এই তিন দিয়ে গঠিত বিভাগ বরিশালে।
বরিশাল বিভাগের জেলা পর্যায়ে প্রতিযোগিতা হয়েছিল ১৫৫টি স্কুল দাবা দলের মধ্যে। সেখান থেকে চ্যাম্পিয়ন দলগুলো অংশ নেয় বিভাগীয় প্রতিযোগিতায় এবং বরিশাল জিলা স্কুলের ‘শাপলা টিম’ হয় বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন।
চ্যাম্পিয়ন দলটির অন্যতম সদস্য অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া রাদমিম রাহা রাজ্য। তার এ সাফল্যে গর্বিত পরিবারের সদস্যরা। কথা হয় রাজ্যের মা হোসেনী জাহিদা পারভীনের সঙ্গে। সন্তানের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত জাহিদা পারভীন বলেন, ছোটবেলা থেকেই রাজ্য পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় বেশ ভালো। ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা পছন্দ করলেও ওর ধ্যান-জ্ঞান ছিল দাবা খেলা। নিজের চেয়ে বয়সে বড়দের প্রায়ই দাবা খেলায় হারিয়ে দিত রাজ্য। বড় হয়ে সে গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীবের মতো খেলোয়াড় হতে চায়।
বরিশাল জিলা স্কুলের শাপলা টিমের আরেক সদস্য উৎস সরকার। বড় হয়ে সে হতে চায় বিশ্বের সেরা দাবাড়ু। কিন্তু বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে উৎসকে। দাবা খেলার বোর্ডসহ নানা উপকরণ ছাড়াই অনুশীলন করতে হয় তাকে। বড় কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। তারপরও এগিয়ে চলছে তার পথচলা। আগ্রহ আর চেষ্টা থাকলে অসম্ভবকে জয় করা যায়। সেটা মেনেই ইউটিউবের নানা ভিডিও দেখে দাবার খুঁটিনাটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করছে উৎস। তার স্বপ্ন, একদিন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে। দাবার বিশ্বদরবারে পত পত করে উড়বে লাল-সবুজের পতাকা।
করোনা অতিমারির সময় ঘরে বন্দী থাকতে হতো বলে মন খারাপ থাকত যুনায়েদ রহমানের। খুব বোরিং সময় যাচ্ছিল। স্কুল বন্ধ, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ নেই। মাঠে গিয়েও খেলার মতো সুযোগ ছিল না। এক বিকেলে বাবার সঙ্গে দাবা খেলতে বসে যুনায়েদ। খেলায় এতটাই মগ্ন ছিল দুজন, কখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে গেছে—টেরই পায়নি বাবা-ছেলে। এরপর পুরো বিধিনিষেধের অলস সময়টায় দাবা খেলায় মজে ছিল বরিশাল জিলা স্কুলের ছাত্র যুনায়েদ। তার সেই অধ্যবসায় বিফলে যায়নি। বিভাগের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন করিয়েছে নিজের স্কুলকে।
এই দলের আরেক সদস্য হাসনাইন ইসলাম মুনিম। মুনিম সুযোগ পেলেই চাচা, ফুফু, মামা ও খালামনির সঙ্গে দাবা খেলতেন। দাবার প্রতি ভালোবাসার গল্পটা শোনা যাক মুনিমের মুখেই, ‘আমার লক্ষ্য থাকত খেলায় বিজয়ী হওয়ার। বাবার সঙ্গে খেলতে গিয়ে প্রায়ই ঝামেলা হতো। বাবা জিতে গেলেই আমি তা মেনে নিতে পারতাম না। মায়ের মধ্যস্থতায় বাবার সঙ্গে চুক্তি হয়, মন্ত্রী ছাড়া খেলতে হবে আমার সঙ্গে! জিততে পারলেই আমার আনন্দ। এভাবেই বাবা আমাকে বিজয়ী হওয়ার সুযোগ করে দিতেন। আর আমি দাবা খেলার উৎসাহ পেতাম।’
বলতে বলতে অন্য রকম এক আনন্দে ঝলমলিয়ে ওঠে মুনিমের চোখ-মুখ, ‘আমার ছোট চাচ্চু আমাকে দাবা খেলার সামগ্রী উপহার দিতেন, যা অন্য সব দামি উপহারের চেয়ে আমার কাছে মূল্যবান মনে হতো। মাঝখানে দীর্ঘ সময় লেখাপড়ার চাপে দাবা খেলা হতো না। মূলত করোনা আমাকে মাঠ থেকে সরিয়ে নতুন করে আবার দাবার ভুবনে নিয়ে আসে। খেলার প্রতি আমার আগ্রহ দেখে করোনা-পরবর্তী সময়ে বাবার অনুপ্রেরণায় নাম লেখাই দাবা প্রতিযোগিতায়।’
এরপরের গল্পটা তো সবার জানা। অসংখ্য মেধাবী দাবাড়ু দলকে হটিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় মুনিমের স্কুল।
এস এম হাসিবুল আলম দিহানের বাবার বদলির চাকরি। তাই বাবাকে ছাড়াই থাকতে হয় তাকে। বাবার অনুপস্থিতির কষ্ট কিছুটা হলেও দিহানকে ভুলিয়ে দেয় দাবা। দাবা দেখলেই মন ভালো থাকে তার। যেমনটি হয় চ্যাম্পিয়ন দলের অন্য সদস্য রুবাইয়াত আফরোজ অর্ণবেরও।
বরিশাল বিভাগের প্রতিযোগিতায় প্রথম রানারআপ হয়েছে বরগুনা জিলা স্কুল এবং দ্বিতীয় রানারআপ হয়েছে কাঠালিয়া সরকারি পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয়, ঝালকাঠি।
দেশসেরা দাবাড়ু হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করার যে স্বপ্ন আর অদম্য ইচ্ছা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে খুদে দাবাড়ুরা—সেটা সফল হবে বলেই আশাবাদী ‘মার্কস অ্যাকটিভ স্কুল চেস চ্যাম্পস’–এর আয়োজকেরা।