ঢাকায় মেকানিকের কাজ শিখতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরল কিশোর কাইয়ুম
১৭ বছর বয়সী আবদুল কাইয়ুম আহাদ কোনো রাজনীতি করত না; পড়ত না কোনো স্কুল কিংবা মাদ্রাসায়। জীবিকার তাগিদে মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই গ্রাম ছেড়ে রাজধানী ঢাকায় পাড়ি জমায় সে। যাত্রাবাড়ীতে সে রেফ্রিজারেটর ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) মেরামতের কাজ শিখত। কিন্তু তার কাজ শেখাটা আর শেষ হলো না।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের পাশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় গুলিতে ঝাঁঝরা হয় তার শরীর।
আবদুল কাইয়ুমের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার নরোত্তমপুর ইউনিয়নের নরোত্তমপুর গ্রামে। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করা আবদুল কাইয়ুম ছয় মাস আগে কাজ শিখতে ঢাকায় গিয়েছিল। স্বপ্ন ছিল কাজ শিখে পরিবারের হাল ধরবে। কিন্তু এর আগেই সে বাড়ি ফিরল লাশ হয়ে।
বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক নয়টার দিকে সড়কের পাশ থেকে কাইয়ুমকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করেন কয়েকজন পথচারী। পরে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। গত শুক্রবার সকাল নয়টায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজনের বরাত দিয়ে স্বজনেরা জানান, একই ঘটনায় গুলিতে কাইয়ুম ছাড়াও আরও দুজন নিহত হয়েছেন। তাঁদের কারও লাশেরই ময়নাতদন্ত করা হয়নি। স্বজনেরা এসব লাশ বাড়িতে নিয়ে গেছেন।
সম্প্রতি নরোত্তমপুরে কাইয়ুমের গ্রামের বাড়িতে ঢুকতেই ভেতর থেকে ভেসে আসছিল স্বজনদের আহাজারি। সন্তানের জন্য বুক চাপড়ে বিলাপ করছিলেন মা বিবি খোদেজা। প্রতিবেশী ও স্বজনদের সান্ত্বনা তাঁকে এতটুকুও শান্ত করতে পারছিল না। বিলাপ করতে করতে বারবার তিনি বলছিলেন, ‘আমার বুকের মানিকের কী অপরাধ ছিল। সে তো কোনো দল করত না। তাকে কেন এভাবে গুলি করে মারা হলো। আমি এর বিচার চাই।’
বিবি খোদেজা প্রথম আলোকে বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে কাইয়ুমকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে রাত নয়টার দিকে এক ব্যক্তি ফোন ধরে হাসপাতালে যেতে বলেন।
চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে কাইয়ুম ছিল সেজ। আদরের সন্তানের কথা বলতে গিয়ে খোদেজা বলেন, ‘আমার ছেলের বুকে গুলি করা হয়েছে। মুখ, গলাসহ বুক গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। ডান হাতের কনুই, বাঁ হাঁটু ও বুকের বাঁ পাশে গুলি করা হয়েছে। গুলি করে ছেলেকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা হয়েছে। কী অপরাধ ছিল আমার ছেলের? কারা আমার বুকের মানিকেরে এভাবে মারল? আমি কি নিয়ে থাকব?’
কাইয়ুমের বাবা আলাউদ্দিন বলেন, ‘পড়ালেখার প্রতি কিছুটা অনাগ্রহ ছিল কাইয়ুমের। ছেলেটার বয়স কম হলেও অনেক লম্বা হয়ে গেছে। তাই সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ছয় মাস আগে তাকে যাত্রাবাড়ীতে একটি প্রতিষ্ঠানে ফ্রিজ ও এসি মেরামতের কাজ শিখতে পাঠাই। অনেক স্বপ্ন ছিল ছেলেকে নিয়ে। ছেলে কাজ শিখবে, সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু তার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। খুব কাছে থেকে ইচ্ছা করে তাকে গুলি করা হয়েছে। তার তো কোনো অপরাধ ছিল না।’
কাইয়ুমের বড় ভাই শুভ আহমেদ তুহিন বলেন, ঢাকায় কাইয়ুম যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করত, সেখানে কথা বলে জেনেছেন, তাঁর ভাই বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে কাজ শেষ করে ম্যানেজারের কাছ থেকে ৫০ টাকা নিয়ে নাশতা করতে বের হয়েছিল। এমন সময় দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি শুরু হয়। পরে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের পাশের একটি রাস্তা দৌড়ে পালানোর সময় পুলিশ কাইয়ুমকে লক্ষ্য করে একাধিক গুলি ছোড়ে।