টেকনাফে খুন-গুমের বিচার না পেয়ে চোখের জলে ভাসেন স্বজনেরা
কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ। এই উপজেলায় দিন দিন বাড়ছে খুন, গুম ও অপহরণের মতো অপরাধ। সর্বশেষ গত ২৪ মে সন্ধ্যায় র্যাব ও পুলিশ টেকনাফের দমদমিয়া পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে তিন ব্যক্তির অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে। এসব কারণে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের ১৭টি গ্রামের অন্তত ৬০ হাজার মানুষ।
হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও বাহারছড়া ইউনিয়নের এসব গ্রামের আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে রোহিঙ্গাদের চারটি আশ্রয়শিবির। এসব আশ্রয়শিবিরে আড়াই লাখ রোহিঙ্গার বাস। রোহিঙ্গাদের চারটি সন্ত্রাসী বাহিনী বাংলাদেশিদের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদেরও অপহরণ করছে। টাকা না পেলে হত্যার পর লাশ গুমের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। গত ৬ মে ‘মুক্তিপণের জন্য টেকনাফে ৬ মাসে অপহৃত ৬২ জন’ শিরোনামে প্রথম আলোতে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যমতে, গত দুই সপ্তাহে মুক্তিপণের জন্য অন্তত আটজনকে অপহরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জন রোহিঙ্গা। গত সাত মাসে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৭৩ জনকে অপহরণ করা হয়। এর মধ্যে ৩৫ জন স্থানীয় বাসিন্দা। বাকি ৩৮ জন রোহিঙ্গা। অপহৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৯ জন মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন বলে ভুক্তভোগী পরিবার সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু বরাবরের মতোই অপহরণকারী সন্ত্রাসীরা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্বজন হত্যার বিচার না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন টেকনাফের অসংখ্য পরিবার। গতকাল সোমবার এমন তিনটি পরিবারে গিয়ে কথা হয় স্বজনদের সঙ্গে।
ছেলের জন্য কাঁদছেন জরিনা
টেকনাফ শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমোরা গ্রামে আবদুল মোনাফের টিনশেডের বাড়ি। মুক্তিপণ না পেয়ে ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট রাতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা মোনাফের বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় তাঁরা গুলি করে হত্যা করে তাঁর ছেলে ওমর ফারুককে (২৮)। ঘটনার ৩ বছর ১০ মাস পার হলেও কোনো আসামি ধরা পড়েনি। ওমর ফারুক হ্নীলা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ছিলেন।
গতকাল সোমবার দুপুরে আবদুল মোনাফের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের ছবি বুকে নিয়ে কান্নাকাটি করছেন মা জরিনা বেগম (৫২)। বিলাপের সুরে জরিনা বলছিলেন, ‘ও পুঁত তরে ছাড়া চোখত ঘুমত ন আইয়ের। তর আগে কেন আঁর মরন ন আইল।’ (ওরে বাবা, তোকে ছাড়া চোখে ঘুম আসে না। তোর আগে কেন আমার মরণ হলো না)।
জরিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা ডাকাত নুর মোহাম্মদের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী ঘরে ঢুকে হত্যা করে তাঁর ছেলে ফারুককে। ঘটনার সময় টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ (অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রদীপ কুমার দাশ) বাড়িতে এসে কত সান্ত্বনা দিয়ে গেলেন। তখন কত মানুষকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হচ্ছিল। অথচ ফারুকের হত্যাকারীরা কেউই ধরা পড়ল না।
ফারুকের বাবা আবদুল মোনাফ (৭৫) বলেন, ছেলে হত্যার ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট টেকনাফ থানায় জাদিমুরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসী নুর মোহাম্মদসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। কিন্তু এ পর্যন্ত মামলার কী অবস্থা তিনি জানেন না। শুরুর ছয় মাস থানায় যোগাযোগ করেও তিনি মামলার এজাহারের কপি তুলতে পারেননি। এ পর্যন্ত পুলিশ তাঁর বাড়িতেও যায়নি।
পুলিশ অনেক আগেই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে জানিয়ে টেকনাফ মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. নাছির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাটি সাড়ে তিন বছর আগের। তবে মামলাটি এখন কী অবস্থায় আছে তাঁর জানা নেই। বাদীপক্ষের কেউ থানায় যোগাযোগ করেননি।
হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক হত্যার প্রতিবাদে তখন স্থানীয় লোকজন টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কে সপ্তাহব্যাপী মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার তেমন অগ্রগতি নেই।
নির্ঘুম রাত কাটান খতিজা-সাবিয়া
২০২০ সালের ১৮ মে রাতে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের মিনাবাজারে ধানখেত পাহারা দিচ্ছিলেন স্থানীয় মোহাম্মদ শাহেদ (২৫), মোহাম্মদ ইদ্রিস (৩০) ও আক্তার উল্লাহ (২৪) নামের তিন বাংলাদেশি নাগরিক। এ সময় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা তিনজনকে অপহরণ করে টেকনাফের পাহাড়ে নিয়ে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।
আক্তার উল্লাহর বাবা মো. আবুল কাশেম বলেন, ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে তখন তিনি এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন। পরদিন আক্তার উল্লাহকে হত্যা করে লাশ পাহাড়ের ঝিরিতে ফেলে দেওয়া হয়। পুলিশ আক্তার উল্লাহর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় টেকনাফ থানায় রোহিঙ্গা হাকিম বাহিনীর প্রধান আবদুল হাকিমসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন আবুল কাশেম। কিন্তু এ পর্যন্ত কেউ ধরা পড়েনি।
মিনাবাজারের পশ্চিম দিকে মোরাপাড়া পাহাড়ের পাদদেশে আক্তার উল্লাহর পলিথিনের ছাউনির মাটির ঘর। গতকাল বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের সামনে চেয়ারে বসে ছেলের জন্য কান্নাকাটি করছেন মা খতিজা বেগম (৫২)। তিনি বলেন, ছেলের জন্য সাড়ে তিন বছর ধরে কাঁদছি। এখনো বিচার পাইনি।
আক্তার উল্লাহর বাড়ির কিছুটা দূরে পাহাড়ের পাদদেশে শাহেদের মাটির ঘর। শাহেদের বাবা মো. হোসাইন বলেন, মুক্তিপণের জন্য শাহেদ ও মোহাম্মদ ইদ্রিসকে টানা এক মাস পাহাড়ের আস্তানায় আটকে রেখেছিল হাকিম ডাকাতের লোকজন। সেখান থেকে পালিয়ে রক্ষা পান ইদ্রিস। পরে তাঁর দেওয়া তথ্যমতে পুলিশ পাহাড়ের খাল থেকে শাহেদের লাশ উদ্ধার করে।
এ বিষয়ে টেকনাফ থানা-পুলিশ জানায়, অপহরণের ঘটনায় হাকিম ডাকাতসহ চারটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী জড়িত। ইতিমধ্যে ১০-১২ জন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মিয়ানমারে আত্মগোপন করায় হাকিমসহ শীর্ষ কয়েকজন সন্ত্রাসীকে ধরা যাচ্ছে না। হাকিম ডাকাতের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় হত্যা, ধর্ষণ, অস্ত্র, মাদকসহ ২১টি মামলা বিচারাধীন।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, তাঁর ইউনিয়নের কম্বনিয়াপাড়া মহেশখালিয়াপাড়া, কাঞ্জরপাড়া, খারাংখালী, সাতঘড়িয়াপাড়া, রইক্ষ্যং এলাকার ১০ হাজার মানুষ অপহরণ–আতঙ্কে ভুগছেন।