জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে এসে নাবিক তারেকুল বললেন, ‘দিনগুলো ভুলে যেতে চাই’
সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে ৩৩ দিন জিম্মি ছিলেন বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিক তারেকুল ইসলামসহ ২৩ জন নাবিক। তাঁরা জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছেন গত ১৪ এপ্রিল। আজ বুধবার সকালে সোয়া ছয়টার দিকে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের ছকরিকান্দি গ্রামের বাড়িতে ফেরেন তারেকুল ইসলাম। এ সময় স্বজনেরা আপ্লুত হয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরেন।
পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তারেকুল ইসলাম (২৯) বলেন, ‘জিম্মিদশার দিনগুলোতে আমাদের সঙ্গে যা হয়েছে, তা ভুলে যেতে চাই।’
গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রামে তারেকুলকে আনতে যান তাঁর বড় ভাই মো. হাসান ইসলাম। এরপর হানিফ পরিহনের একটি বাসে করে তাঁরা দুই ভাই আজ সকালে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছান।
জিম্মি হওয়ার দিনটির বিবরণ দিয়ে তারেকুল ইসলাম বলেন, ১৩ মার্চ সকাল ১০টার আগে একটি ফিশিং বোট তাঁরা দেখতে পান। ওটা দেখে বোঝার উপায় ছিল না, ওটা ফিশিং বোট নাকি জলদস্যুদের বোট। তবে ওই বোট তাঁদের জাহাজের চার নটিক্যাল মাইলের মধ্যে চলে এলে দ্রুতগতির একটি বোট নামায় সাগরে। এটা দেখে তাঁরা বুঝতে পারেন, এটি জলদস্যুদের বোট। তাঁদের জাহাজটি জলদস্যুদের লক্ষ্যবস্তু। তখন জাহাজে অ্যালার্ম বাজানো হয়। ওরা যাতে জাহাজে উঠতে না পারে, সে জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু একসময় সব পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়ে যায়। ওরা জাহাজে এসে প্রথমে গুলি ছুড়ে উল্লাস করতে শুরু করে। একসময় তাঁদের জিম্মি করে ফেলে। তখন থেকে শুরু হয় তাঁদের জিম্মিদশা।
তারেকুল ইসলাম বলেন, ‘ওদের হাতে আমরা বন্দী। ওদের নির্দেশ আমাদের মানতে হয়। ওদের কথামতো, আমাদের জাহাজ চালাতে হয়। ওরা আমাদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি লোড করে দাঁড়িয়ে থাকে। যেকোনো সময়, মিস ফায়ার থেকেও দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।’
তারেকুল বলেন, ‘ওই পরিস্থিতিতে কী হয়েছিল, আমাদের মনের অবস্থা, তা ভাষায় বর্ণনা দিতে পারব না। প্রতিটা মুহূর্তে মনে হয়েছে, এই হয়তো গুলি করে দেবে, সব শেষ হয়ে যাবে। তখন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছি, পাশাপাশি এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহর সাহায্য চেয়েছি। এভাবে দিন গড়াতে থাকে। একসময় ওদের কোস্টে আমাদের জাহাজ পৌঁছে যায়। ওদের এক অনুবাদক চলে আসেন। তিনি আমাদের কোম্পানির সিওর সঙ্গে কথা বলেন। আমাদের কোম্পানির সিও তাদের প্রস্তাবে দ্রুত সাড়া দেন। এতে ওরা খুশি হয়।’
বন্দী থাকা অবস্থায় জলদস্যুরা নির্যাতন করেনি উল্লেখ করে তারেকুল বলেন, ‘ওরা দু–একবার ধাক্কা–গুঁতা দিয়েছে। তবে ধরেবেঁধে লাঠিপেটা করা, এমন কিছু করেনি। তবে তারা সব সময় আমাদের গুলির মুখে রাখত। এতে ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়েছে।’
বন্দিজীবনের একটি দিনের বর্ণনা দিয়ে তারেকুল বলেন, ‘একবার আমরা সবাই জলদস্যুদের ফাঁকি দিয়ে পালানোর চেষ্টা করি। আমরা ২৩ জনের মধ্যে ২১ জন পালিয়েও গিয়েছিলাম। কিন্তু যখন দেখতে পারলাম, জলদস্যুরা আমাদের দুই সদস্যকে ধরে ফেলেছে, তখন আমরা আবার স্বেচ্ছায় জলদস্যুদের কাছে ফিরে যাই।’
বাড়িতে এসে কেমন লাগছে—জানতে চাইলে তারেকুল বলেন, এখন মানসিকভাবে আনন্দ অনুভব করছেন। বাবা–মা, স্ত্রী–সন্তান ও বড় ভাই সবার সঙ্গে আছেন। তাঁর দেড় বছরের মেয়ে তানজিরা তাঁকে চিনতে পেরেছে। ‘বাবা’, ‘বাবা’ বলে তাঁর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এতে তাঁর সব দুঃখ–কষ্ট ও যন্ত্রণা নিমেষেই হাওয়া হয়ে গেছে।
নিজের ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ের তারেকুল বলেন, ‘আমি আমার পেশাতেই ফিরে যাব। তবে প্রত্যাশা করি, ওই দিনগুলো যেন এ জীবনে আর না আসে। আমি ওই দিনগুলোর কথা ভুলে যেতে চাই।’
মধুখালী উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের ছকরিকান্দি গ্রামের বাসিন্দা মো. দেলোয়ার হোসেন (৬৪) ও হাসিনা বেগম (৬২) দম্পতির ছেলে তারেকুল ইসলাম। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। বড় বোন দুলিয়া সুলতানার (৪১) বিয়ে হয়েছে পাশের বোয়ালমারী উপজেলার একটি গ্রামে। বড় ভাই মো. হাসান ইসলাম (৩৬) ঢাকায় একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন।
বাড়ির পাশের ছকরিকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পাট চুকিয়ে ২০০৪ সালে ঢাকার মিরপুর-১২ এলাকায় ডক্টর শহীদুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন তারেকুল। একই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০৯ ও ২০১১ সালে যথাক্রমে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। পরে ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিতে। পড়াশোনা শেষ করে ২০১৭ সালে চাকরি নেন চায়না কোম্পানির একটি জাহাজে। এরপর আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ঘুরে গত বছরের ১ ডিসেম্বর চাকরি নেন এসআর শিপিং লিমিটেড কোম্পানির এমভি আবদুল্লাহ নামের জাহাজে। ওই জাহাজে তিনি তৃতীয় প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
তারেকুল ২০১৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর নাটোরের গুরুদাসপুর এলাকায় বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম নুসরাত জাহান (২১)। তাঁদের তানজিহা ইসলাম নামে দেড় বছর বয়সী এক মেয়ে আছে।
তারেকুলের মা হাসিনা বেগম বলেন, ‘ছেলেটা জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। মনে হয়, আমার হারানো মানিক ফিরে এসেছে। এ আনন্দ বলে বোঝানোর নয়।’ হাসিনা বেগম আরও বলেন, ‘আমার মনের আকুতি আল্লাহ শুনেছে। যেকোনো কিছুর মূল্যে আমার ছেলেসহ সবাই যেন মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসে, সেই দোয়াই আল্লাহর কাছে করেছি।’
তারেকুলের বাবা দেলোয়ার হোসেন বলেন, আজ ছেলেকে কাছে পেয়ে বুকের ভেতর চেপে বসে থাকা একটি পাথর যেন সরে গেল। এ জন্য জাহাজ কর্তৃপক্ষ, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
১২ মার্চ মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হারমিয়া বন্দরে যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ। জাহাজটি জিম্মি করার পর সোমালিয়ার গদভজিরান জেলার জেফল উপকূলের কাছে নিয়ে যায় দস্যুরা। ৩৩ দিন জিম্মিদশার পর মুক্তিপণের বিনিময়ে ২৩ জন নাবিকসহ এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি মুক্ত হয়। চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের জাহাজটি পরিচালনা করে আসছিল গ্রুপটির সহযোগী সংস্থা এসআর শিপিং লিমিটেড।