রাস্তার ধারে চা বিক্রি করে সংসার চালান শাহিনুর, স্বপ্ন দেখেন ছেলেকে মানুষ করার
বিয়ের পর প্রথম কয়েক বছর রিকশাচালক স্বামীর আয়ে বেশ ভালোই চলছিল গৃহবধূ শাহিনুরের সংসার। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে সংসারের পরিধি। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে লেখাপড়া করে। ক্রমেই তাঁদের সংসারের খরচ বাড়তে থাকে। হাঁপিয়ে ওঠেন তাঁর রিকশাচালক স্বামী। বাধ্য হয়ে পোশাক কারখানায় কাজ করেন শাহিনুর। কিন্তু হঠাৎ শাহিনুরের জটিল রোগ ধরা পড়ে। চিকিৎসকেরা তাঁকে চাকরি ছাড়ার পরামর্শ দেন। এরপর গ্রামে ফিরে কিস্তিতে ঋণ নিয়ে ছোট্ট একটি চা, পান ও বিড়ি-সিগারেটের দোকান দিয়ে বসেন শাহিনুর।
শাহিনুরের বাড়ি জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার ভেঙ্গুড়া গ্রামে। তাঁর স্বামী রাশেদুল ইসলাম পেশায় একজন রিকশাচালক। বিয়ের আগে দরিদ্র বাবা-মায়ের সঙ্গে গাজীপুরে থাকতেন। সেখানেই রিকশাচালক রাশেদুলের সঙ্গে পরিচয়-বিয়ে। প্রায় ২০ বছর আগে পারিবারিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয়। প্রথমদিকে ভালোই চলছিল তাঁদের সংসার। বড় সন্তানের লেখাপড়ার খরচ ও সংসারে কিছুটা সহযোগিতা করতে পোশাক কারখানায় চাকরি নেন শাহিনুর। হঠাৎ তাঁর মাথায় নানা সমস্যা দেখা দেয়।
শাহিনুরের ভাষ্য, এরপর বাধ্য হয়ে সপরিবার গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান তাঁরা। পরে একজনের পরামর্শে বাড়ির সামনেই রাস্তার ধারে চা, পান ও বিড়ি-সিগারেটের দোকান দিয়ে বসেন। এভাবেই প্রায় দুই বছর ধরে দোকান করে সংসার সামলাচ্ছেন তিনি।
গত শুক্রবার সকালের দিকে ওই এলাকায় গিয়ে শাহিনুরের দেখা পাওয়া যায়। তখন চারদিক ঢেকে ছিল ঘন কুয়াশায়। কনকনে শীতে রাস্তাঘাট একেবারেই ফাঁকা। লোকজনের কোলাহল নেই বললেই চলে। এমন সময়ে একটি চাদর গায়ে জড়িয়ে দোকানে বসে ছিলেন শাহিনুর। তাঁর সামনে একটি চুলায় জ্বলছিল গনগনে আগুন। এটির ওপর কেটলিতে ফুটছিল গরম চা। হঠাৎ কনকনে ঠান্ডায় দুজন যুবক তাঁর দোকানে গরম-গরম চা খেতে আসেন। শাহিনুর নিজের হাতে চা বানিয়ে তাঁদের দিলেন।
আক্ষেপের ঝুলি খুলে এবার শাহিনুর বেগম বলেন, ‘সংসার চালাতে কতই না কষ্ট করলাম। গার্মিছে (গার্মেন্টস) কত কষ্ট করছি। ছেলে-মেয়েরা বড় হইলে, হেই কষ্ট দূর হবে—কিন্তু ভাইগ্য খারাপ। সেইটা আর হয় নাই। অনেক কষ্টে বড় পোলাকে লেখাপড়া করাইছিলাম। কিন্তু হেই ছেলে প্রেম করে বিয়ে করল। এর পর থেকে কুনো দিনই আমাগো খোঁজ নেয়নি। বউ নিয়া হে নারায়ণগঞ্জ থাহে। ম্যালা কষ্টে দুই মাইয়্যারে বিয়া দিছি। আমগো সঙ্গে এহন সব্বার ছোডো পোলাডা থাহে। ইবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠল ও। ট্যাহার অভাবে এহনো তারে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করাইতে পারি নাই। ওই পোলাটা নিয়েই আমি দোকানটা চালাই। আর স্বামী চালায় রিকশা। দুজনের আয় দিয়ে কোনো রহমে চলতাছি।’
অনেক কষ্টে বড় পোলাকে লেখাপড়া করাইছিলাম। কিন্তু হেই ছেলে প্রেম করে বিয়ে করল। এর পর থেকে কুনো দিনই আমাগো খোঁজ নেয়নি। বউ নিয়া হে নারায়ণগঞ্জ থাহে। ম্যালা কষ্টে দুই মাইয়্যারে বিয়া দিছি। আমগো সঙ্গে এহন সব্বার ছোডো পোলাডা থাহে। ইবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠল ও। ট্যাহার অভাবে এহনো তারে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করাইতে পারি নাই। ওই পোলাটা নিয়েই আমি দোকানটা চালাই।শাহিনুর বেগম, চা বিক্রেতা
শহর থেকে গ্রামে ফিরে কিস্তিতে ঋণ নিয়ে ছোট্ট একটি ঘর তৈরির পাশাপাশি স্বামীকে একটি রিকশা কিনেন দিয়েছিলেন শাহিনুর। পরে আরও ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে দোকান দাঁড় করিয়েছেন। শাহিনুর জানান, গ্রামের মধ্যে দোকান হওয়ায় তেমন একটা বিক্রি হয় না। আগে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা বিক্রি হতো। এখন ঠান্ডার কারণে বিক্রি কমে গেছে। কারণ, রাস্তাঘাটে তেমন একটা লোকজন নেই। এভাবে যুদ্ধ করেই চলছেন।
শাহিনুরের দোকানে চা খেতে মিজানুর রহমান নামের স্থানীয় এক যুবক বলেন, ‘গ্রামের সবাই আমরা তাঁকে (শাহিনুর) চাচি বলে ডাকি। তিনি সেই ভোরবেলায় দোকান খোলেন এবং গভীর রাত পর্যন্ত থাকেন। মাঝেমধ্যে তাঁর ছেলেও বসে দোকানে। চাচি অনেক কষ্ট করেন। তাঁকে দেখে অনেক কষ্ট হয়। সংসারের জন্য অনেক কষ্ট করেন। তবে চাচি অনেক ভালো চা বানান।’
আলাপচারিতায় শাহিনুর আরও বলেন, শীতের কারণে তাঁর সঙ্গে স্বামীরও আয় কমে গেছে। স্বামী অসুস্থ থাকায় ঠান্ডায় ঠিকমতো রিকশা চালাতে পারেন না। তাঁর দোকানেও বিক্রি কমে গেছে। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে ৩ হাজার ২০০ টাকা কিস্তি দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে সব জিনিসপত্রের দামও অনেক। কোনোরকমে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে আছেন। সংসার টেকানো কঠিন হয়েছে।
এত সব প্রতিকূলতার মধ্যেও ছোট ছেলেকে মানুষ করার স্বপ্ন দেখেন শাহিনুর। তাঁর প্রত্যাশা, ছোট ছেলে তাঁর বড় ভাইয়ের মতো করবে না। বড় হয়ে বৃদ্ধ মা-বাবাকে দেখাশোনা করবে। তাই অনেক কষ্ট করে হলেও ছেলের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। শাহিনুর বলেন, ‘যেভাবেই হোক, পোলারে ভর্তি করামু, যাতে বড় হইয়্যা আমগো কষ্ট দূর করে।’