ভোটে আজমত সব এলাকায় পিছিয়ে, এগিয়ে শুধু টঙ্গীতে

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে হেরে যান আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী আজমত উল্লা খান
ফাইল ছবি

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী আজমত উল্লা খানের নিজের এলাকা টঙ্গী। সেই টঙ্গী এলাকার ভোটে এগিয়ে থাকলেও অন্তত আটটি কেন্দ্রে ২০০ ভোটেরও কম পেয়েছেন। টঙ্গী ছাড়া অন্য প্রায় সব এলাকাতেই আজমত উল্লা খানের চেয়ে মেয়র পদে জয়ী জায়েদা খাতুন বেশি ভোট পেয়েছেন। গাজীপুর-১ আসনের ওয়ার্ডগুলোতে আজমত উল্লা খান ও জায়েদা খাতুন প্রায় সমান ভোট পেয়েছেন।

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পাওয়া ৪৮০টি কেন্দ্রের ওয়ার্ডভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে।

গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডল বলেন, ‘দলীয় নেতা-কর্মীরা সবাই নৌকার পক্ষে কাজ করেছেন। তারপরও কেন নৌকার হার হয়েছে, সেটি আমরা সহজভাবে নিতে পারছি না। তাই বিষয়টি নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আমরা আলোচনায় বসব। তখনই নির্বাচনে হেরে যাওয়ার মূল কারণ বলা সম্ভব হবে। এখনই হারের বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারছি না।’

আরও পড়ুন

দলীয় ও স্থানীয় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২০১৩ সালে জাহাঙ্গীর আলমকে দলীয় মনোনয়ন না দিয়ে দেওয়া হয় আজমত উল্লা খানকে। এর পর থেকেই শুরু হয় নানা নাটকীয়তা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তখন জাহাঙ্গীর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। তাতে শেষরক্ষা হয়নি আজমতের। সেই নির্বাচনে এক লাখেরও বেশি ভোটে হেরে যান তিনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাহাঙ্গীরকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয় এবং তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার তিন বছর পর বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে দল থেকে বহিষ্কৃত এবং পরে মেয়রের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত হন। তিন বছরে নগরে দৃশ্যমান উন্নয়নকাজ করে এলাকাবাসীর নজরে পড়েন। নির্বাচনের আগে তাঁর দলীয় শাস্তি মওকুফ করা হয়। পরে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে জাহাঙ্গীর ও তাঁর মা জায়েদা খাতুন দুজনেই প্রার্থী হন। ঋণখেলাপি হওয়ায় তাঁর মনোনয়ন বাতিল হলেও টিকে যায় তাঁর মায়ের মনোনয়ন। এরপর মায়ের হয়ে প্রচারণা চালিয়ে জয় নিয়ে ঘরে ফেরেন জাহাঙ্গীর আলম।

গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের অন্তত আটজন নেতার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা শুরু হলে গাজীপুরের দুই মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা নানাভাবে প্রচারণা চালিয়ে যান। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন কেন্দ্রীয় নেতারা। প্রভাবশালী মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের এলাকায় নৌকার প্রার্থীর হেরে যাওয়াটা খুবই লজ্জার। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলও সামনে এসেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশ দলীয় প্রার্থী বাছাই, ভোটারদের কাছে গিয়ে প্রচারণা না চালানো এবং আজমত উল্লা খানের জনসম্পৃক্ততা কম থাকাকে এই নির্বাচনে পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছে।

গত বৃহস্পতিবার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সব কটি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ করা হয়। নগরীর ৪৮০টি কেন্দ্রেই সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো ছিল। ঢাকায় বসে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করেন নির্বাচন কর্মশনের (ইসি) কর্মকর্তারা। এই নির্বাচনে জায়েদা খাতুন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। আজমত উল্লা খান পান ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট। তিনি ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান।

টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানা (৪৩ থেকে ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড), গাছা থানা (৩২ থেকে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড) ও গাজীপুর সদর মেট্রো (২৩ থেকে ৩১ নম্বর ওয়ার্ড) নিয়ে গাজীপুর-২ আসন। এই আসনের সংসদ সদস্য ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান। টঙ্গী এলাকায় আজমত উল্লা খান সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। টঙ্গী অঞ্চলের ১৬৩টি কেন্দ্রে তিনি পেয়েছেন ৭৩ হাজার ৭৮৪ ভোট। অপর দিকে জায়েদা খাতুন পেয়েছেন ৫৫ হাজার ২৯২ ভোট। ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৭০০ ভোটারের এই এলাকায় ভোট পড়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৭৭২ ভোট। গাজীপুর-২ আসনের মধ্যে পড়া শহর ও আশপাশের এলাকায় জায়েদা খাতুন নৌকার প্রার্থীর তুলনায় বেশি ভোট পেয়েছেন।

আরও পড়ুন

অপর দিকে সিটি করপোরেশনের ১ থেকে ১৮ নম্বর ওয়ার্ড পড়েছে গাজীপুর-১ আসনে। এসব ওয়ার্ডে ১৩২টি কেন্দ্র ছিল। এই আসনের সংসদ সদস্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। এই এলাকায় প্রধান দুই প্রার্থীর ভোটসংখ্যা কাছাকাছি। ওই সব কেন্দ্রে আজমত পেয়েছেন ৬৪ হাজার ৬৮৬ ভোট। আর জায়দা পেয়েছেন ৫৮ হাজার ৬১৩ ভোট। এ ছাড়া নগরীর ৩৯ থেকে ৪২ নম্বর পর্যন্ত চারটি ওয়ার্ডের ৩২টি কেন্দ্র পড়েছে গাজীপুর-৩ আসনের মধ্যে। এই আসনের সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকি। ওই ৩২টি কেন্দ্রে জায়েদা খাতুন ভোট পেয়েছেন ২০ হাজার ১৪৩টি এবং আজমত উল্লাহ পেয়েছেন ১৫ হাজার ৫০৪ ভোট।

আওয়ামী লীগের প্রার্থী কেন হেরে গেলেন, জানতে চাওয়া হয়েছিল গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য আবদুল হাদী শামিমের কাছে। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগবিরোধী যত জোট, যত গোষ্ঠী, যত মহল, যত ম্যাকানিজম—সব একত্রিত হয়ে আজমত উল্লা খানের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ নৌকার বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করেছে। এই ঐক্য গড়ার পেছনে আওয়ামী লীগবিরোধী জাতীয় নেতারা জড়িত ছিলেন। শুধু একজন প্রার্থী একা এই ম্যাকানিজম করতে পারেননি।’