লক্ষ্মীপুরে পানি বাড়ছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণের জন্য হাহাকার
লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। হু হু করে বাড়ছে পানি। আজ সোমবার বিভিন্ন এলাকায় পানির উচ্চতা বাড়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
পাশের নোয়াখালী জেলার বন্যার পানি লক্ষ্মীপুরের রহমতখালী খাল হয়ে লক্ষ্মীপুরের লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। আজ দুপুর পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন এলাকায় তিন থেকে ছয় ইঞ্চি পানি বেড়েছে বলে জানিয়েছেন লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান। তিনি বলেন, গত শনিবার অনেক এলাকায় পানি কিছুটা কমে গিয়েছিল। গড়ে ছয় ইঞ্চির মতো কমেছে। কিন্তু সেটা গত দুই দিনে আবার বেড়ে গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, দিঘলী ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে গেছে দিঘলী-মান্দারী সড়ক। সড়কটির অধিকাংশ পানির নিচে। কোথায়ও দুই ফুট, কোথায়ও তিন ফুট পানি। এতে বড় যানবাহন চলাচল বন্ধ আছে। মাঝেমধ্যে ঝুঁকি নিয়ে অটোরিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করছে। অনেক অটোরিকশা মাঝপথে বিকল হয়ে পড়ে আছে। সড়কের চারপাশে পানিতে টইটম্বুর। মসজিদগুলোতে মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতে পারছেন না। কুশাখালীর ছিলাদী গ্রাম, নিশ্চিন্তপুর গ্রামের আশপাশের সব গ্রাম পানিতে একাকার। এসব এলাকার বানভাসি মানুষ জানিয়েছেন, এমন দুর্বিষহ অবস্থা ১৯৮৮ সালের বন্যার সময়ও হয়নি। বন্যা আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে।
চন্দ্রগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা মাসুদ খান বলেন, গ্রামের বেশ কটি সড়ক বিকেল পর্যন্ত শুকনা ছিল। রাতে সেসব সড়কে এক ফুট পর্যন্ত পানি উঠে গেছে। চন্দ্রগঞ্জ-মান্দারী সড়কসহ সব সড়কেই পানি।
কুশাখালীর ছিলাদী গ্রামের বাসিন্দা মো. ফয়সাল মাহমুদ বলেন, রোববার রাতে বাড়ির আঙিনায় পানি ছিল প্রায় এক থেকে দেড় ফুট। রাত তিনটার দিকে পানি দ্বিগুণ হয়ে যায়। এতে নতুন করে ভোগান্তির সৃষ্টি হয়।
কমলনগর উপজেলার চর কাদিরা গ্রামের রিয়াজ হোসেন বলেন, ‘পানিবন্দী হয়ে থাকলেও এখনো কোনো ত্রাণ পাইনি। খুবই কষ্টে দিন কাটছে। কাজকর্ম করা যাচ্ছে না। মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। দুশ্চিন্তায় আছি। যেভাবে পানি বাড়ছে, কোথায় গিয়ে ঠেকে, সেটাই এখন চিন্তার বিষয়।’
একই এলাকার দোকানি মো. বাহার বলেন, রাতে দোকান ঝাড়ু দিয়ে মুছে গিয়েছি। সকালে এসে দেখি দোকানের ভেতরে এক ফুট পানি। পেছনের বাড়িঘর সব পানিতে ডুবে গেছে।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণের জন্য হাহাকার
জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বন্যার্ত মানুষের মধ্যে শুকনা খাবার, চাল-ডালসহ নানা সামগ্রী বিতরণ করছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো কোনো এলাকার মানুষ এখনো ত্রাণ পাননি।
সদর উপজেলার ভাঙ্গাখা ইউনিয়নে আজাদ হোসেন বলেন, সবাই প্রধান সড়কের আশপাশে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন। পানির জন্য কেউ ভেতরের দিকে আর ঢোকেন না। অথচ প্রধান সড়ক থেকে মাইলের পর মাইল ভেতরের দিকে বসতি আছে।
কমলনগর উপজেলার চর কাদিরা গ্রামের বাসিন্দা আরিফ হোসেনের বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। গতকাল রোববার বিকেলে তাঁর সঙ্গে কথা হয় লক্ষ্মীপুর-কমলনগর সড়কে। তিনি বলেন, তাঁর পরিবার গত এক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দী। লক্ষ্মীপুর-কমলনগর সড়ক থেকে তিন কিলোমিটার ভেতরে তাঁর বাড়ি। তাঁর পরিবার আজ পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পাননি। ত্রাণের আশায় তিনি প্রধান সড়কে দাঁড়িয়েছেন। বেসরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের লোকজন পর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণ করছেন কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামে ত্রাণ পৌঁছায়নি।
এখন পর্যন্ত জেলায় বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ৮ হাজার ৫০০ মানুষ। সেসব জায়গায় শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকেই ত্রাণ দিচ্ছেন আশ্রয়কেন্দ্রে।
সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ, কুশাখালী, কমলনগর, রায়পুর, রামগতি ও রামগঞ্জ উপজেলায় ১৮৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া এসব এলাকার বেশির ভাগ সরকারি প্রাথমিক, মাধ্যমিক উচ্চবিদ্যালয় ও মাদ্রাসাগুলো বন্যার্ত মানুষের আশ্রয়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান প্রথম আলোকে বলেন, পানিবন্দী হয়ে সাড়ে ছয় লাখ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। জেলার পাঁচটি উপজেলাই ক্ষতিগ্রস্ত। প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গত এলাকার মানুষের জন্য প্রাণ পৌঁছানো হচ্ছে।