মেহেরপুর সদর
সেতুর কাজ ফেলে ঠিকাদার লাপাত্তা
সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের জুন মাসে। সেই মেয়াদ শেষ হয়েছে ৮ মাস হলো। আর কাজ ফেলে ৭ মাস ধরে ঠিকাদার লাপাত্তা।
মেহেরপুর সদর উপজেলার উজলপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে ভৈরব নদ। স্থানীয়ভাবে এটিকে ‘ভৈরবপাড়’ নামেই চেনে মানুষ। উজলপুর গ্রামে সরু এই নদের একটি ঘাট রয়েছে, যার নাম শোয়ারী ঘাট। এই ঘাটে বর্ষায় নৌকা দিয়ে পারাপার চলে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে কাঠ ও বাঁশের পাটাতন রেখে মানুষ চলাচল করে। স্থানীয় লোকজন দীর্ঘদিন ধরে সেখানে একটি সেতু নির্মাণের দাবি করছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এখানে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের জুন মাসে। সেই মেয়াদ শেষ হয়েছে আট মাস হলো। তবে কাজ ফেলে সাত মাস ধরে ঠিকাদার লাপাত্তা।
স্থানীয় বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, সেতু নির্মাণ বন্ধ রেখে বিপাকে ফেলা হয়েছে এলাকাবাসীকে। আগে শোয়ারী ঘাট হয়ে নৌকায় করে সবজি আনা-নেওয়া করা হতো। সেখানে অর্ধেক সেতু তৈরি করে ফেলে রাখার কারণে নৌকায় মালপত্র আনা-নেওয়া করতে অসুবিধা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন সরু সাঁকো তৈরি করেছে। তাতে শুধু হেঁটে পারাপার হওয়া যায়।
সরেজমিন দেখা যায়, সেতুর কয়েকটি পিলারের কাজ হয়েছে। পাশের গার্ডওয়াল হয়নি, সংযোগ সড়ক হয়নি। পাটাতনের কাজও হয়নি। তবে পিলার পাটাতন থেকে রড বেরিয়ে আছে। এখন শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় নদে বেশি পানি নেই। আশপাশের লোকজন বাঁশ ও কাঠ ফেলে যাতায়াত করছেন।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভৈরব নদের একদিকে উজলপুর গ্রাম, অন্যদিকে শোলমারি, শোভরাজপুর গ্রাম। এই তিন গ্রামের মাঠে প্রচুর সবজি, ধান, পাট ও গম হয়। এসব গ্রামের মানুষের একমাত্র ভরসা শোয়ারী ঘাট। দুই পারের কয়েক হাজার মানুষ তাঁদের উৎপাদিত ফসল বাজারে তুলতে নিত্যদিন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। দীর্ঘ সাত মাস ধরে সেতুর কোনো কাজ হয়নি। সেতু নির্মাণের জন্য লোহার রডগুলোতে মরিচা পড়ে গেছে। অনেক যন্ত্রাংশ রাতের বেলায় চুরি হয়েছে।
দেখভালের দায়িত্বে থাকা মো. গরিবল্লাহ বলেন, মাসিক ১৫ হাজার টাকা বেতনে তিনি দেখভালের দায়িত্ব পালন করছেন। সাত মাস কোনো বেতন পাননি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ বন্ধ রেখেছেন। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কেউ না থাকায় কাজও ছাড়তে পারছেন না।
সেতুটির ৪৫ মিটার দূরে সোহেল রানার ভুট্টার খেত। বাঁশের সাঁকো পার হয়ে তিনি খেতের কাজ সেরে বাড়ি যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, একটি সেতু তৈরিতে তিন-চার বছর লাগে? শোনা গেছে, ঠিকাদার নাকি কাজ ফেলে টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছেন। তাঁদের ভোগান্তি কে দেখবে?
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, ৬ কোটি ৩৭ লাখ ৮৩ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ওই সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২১ সালের জুন মাসে। সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ জুন মাসে। এ সময় কেবল সেতুটির দুটি পিলার ও দুই পাশের সংযোগ সড়কের গাইড ওয়াল তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ বিল তুলে নিয়ে ঠিকাদার লাপাত্তা হয়েছেন।
এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী সাব্বির উল ইসলাম বলেন, বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৯৬ মিটার দীর্ঘ সেতুটির নির্মাণকাজটি পায় ফরিদপুরের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কামারজানি ট্রেডার্স। প্রতিষ্ঠানটি কুষ্টিয়ার ঠিকাদার সুমন মিয়াকে সেতু নির্মাণের দায়িত্ব দেন। রড, সিমেন্ট ও অন্য নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় সুমন মিয়া সেতুর ৫৫ শতাংশ কাজ করার পর চলে যান। সেতুটি এখনো সেভাবে পড়ে রয়েছে। তবে সম্প্রতি সেতুটির ঠিকাদার কামারজানি ট্রেডার্সকে তলব করা হয়েছে।
কামারজানি ট্রেডার্স ব্যবস্থাপক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, সেতু নির্মাণের কাজ চলছিল পুরোদমে। হঠাৎ নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যায়। এ কারণে সাব-ঠিকাদার সুমন মিয়া কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। তাই সেতুর কাজ বন্ধ রয়েছে। দ্রুত কাজ শুরু করা না গেলে লোহার রডগুলো মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে যাবে। ওই রড দিয়ে সেতু নির্মাণ করা হলে সেতুর স্থায়িত্ব অনেকাংশে কমে যাবে।
কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিমর রেজা বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষের দিকেও এর কাজ শেষ হয়নি। এই সেতু নিয়ে এ অঞ্চলের জনসাধারণ অনেক ভোগান্তির মধ্যে আছেন। যদি দ্রুত কাজ শেষ না হয়, তাহলে তাঁরা আন্দোলনে নামবেন।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, উজলপুর সেতুর কাজ বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। ঠিকাদার সুমন মিয়া নানান অজুহাত দিয়ে কাজ বন্ধ করে লাপাত্তা হয়েছেন। এসব বিষয় নিয়ে মূল ঠিকাদার কামারজানিকে দ্রুত কাজ শেষ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ করে সেতুর কাজ শেষ করা হবে।