যে মেলায় পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকি বিক্রি হতো
ভোরে সবাই তখনো ঘুম থেকে ওঠেননি। কিন্তু মাঠে উপস্থিত হয়ে গেছেন শুঁটকি ব্যবসায়ীরা। চারপাশজুড়েই বস্তাভর্তি শুঁটকি। ব্যবসায়ীরা দোকান সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কথা বলার ফুরসত নেই তাঁদের। সবাই দোকানে শুঁটকির পসরা সাজাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শুঁটকির মেলার আজ শনিবার সকালের চিত্র। উপজেলার কুলিকুন্ডা গ্রামের কুলিকুন্ডা (উত্তর) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে বছরে দুই দিনব্যাপী এ মেলা হয়। আজ মেলার প্রথম দিন।
গ্রামের লোকজন বলেন, প্রতিবছর বাংলা নববর্ষের দ্বিতীয় দিন এ মেলার আয়োজন করা হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বী পঞ্জিকা অনুযায়ী আজ বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন। এ জন্য পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে স্থানীয় জেলেরা এই দিনে মেলার আয়োজন করেন। মেলা চলবে আজ ও কাল রোববার।
গ্রামবাসী ও মেলায় আসা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কবে মেলার প্রথম আয়োজন হয়েছিল, তা কেউ জানেন না। কেউ কেউ বলেন, শুঁটকির এ মেলা ৪০০ বছরের পুরোনো। আবার কেউ ২০০ থেকে ৩০০ বছরের পুরোনো বলে মত দেন।
এ মেলার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের কয়েকজন বলেন, মুদ্রার প্রচলন যখন হয়নি, তখন স্থানীয় জেলেরা নিজেদের উৎপাদিত শুঁটকি নিয়ে এখানে আসতেন। স্থানীয় কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত ধান, চাল, ডাল, শিমের বিচি, আলু, শর্ষে, পেঁয়াজ, রসুনসহ নানা পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকি কিনতেন। এ মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকি কেনাবেচা। পণ্য বিনিময়ের এ প্রথা স্বল্প পরিসরে কয়েক বছর আগেও ছিল। করোনাভাইরাস মহামারির পর থেকে তা আর নেই। এখন টাকায় লেনদেন হয়। স্থানীয় মানুষের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা শুঁটকি বেচাকেনা করতে এ মেলায় আসেন। শুঁটকির পাশাপাশি মেলায় গৃহস্থালি সামগ্রীসহ শিশুদের নানা ধরনের খেলনাও বিক্রি হয়।
মেলায় আগত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট, হবিগঞ্জ, আশুগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, সুনামগঞ্জ, ভৈরবসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এ মেলায় আসেন। মেলায় বোয়াল, গজার, শোল, বাইম, ছুরি, লইট্টা, পুঁটি, গনা, গুচি, ট্যাংরা, আইড়সহ নানা ধরনের শুঁটকির পসরা নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। এ ছাড়া মেলায় ইলিশ ও নানা বিরল জাতের সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি পাওয়া যায়। শুঁটকি ছাড়াও ইলিশ ও কার্পজাতীয় বিভিন্ন মাছের ডিমও রয়েছে দোকানিদের পসরায়। মেলায় স্থানীয় কুমারদের তৈরি হাঁড়ি, কলসি, থালা, ঘটি, বদনা, বাটি, পুতুলসহ নানা ধরনের সামগ্রীও আছে।
২৩ বছর ধরে মেলায় শুঁটকি বিক্রি করে আসছেন সরাইল উপজেলার মুজিবুর রহমান। এবার সঙ্গে সাতজনকে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, বোয়াল, বাইম, ছুরি, আইল, বামট, রিডাসহ ১২ জাতের মাছের প্রায় ১০ লাখ টাকার শুঁটকি এনেছেন তিনি।
মেলায় প্রথমবার এসেছেন আশুগঞ্জের লালপুরের চিত্তরঞ্জন দাস। তিনি বলেন, ‘২৫ জাতের শুঁটকি এনেছি। এগুলোর বাজারমূল্য তিন লাখ টাকা। মেলায় বেচাকেনা ভালো হয় বলে লোকমুখে শুনেছি। তাই আশা নিয়ে এসেছি।’
সরাইলের পরিমল বিশ্বাস ২০ বছর ধরে, নাসিরনগরের চন্দ্রচর দাস ও শ্রীকৃষ্ণ দাস ৩০ বছর ধরে মেলায় শুঁটকি বেচাকেনা করেন। তাঁরা বলেন, কয়েক বছর ধরে বিনিময়প্রথার মাধ্যমে শুঁটকি বেচাকেনা বন্ধ আছে। তবে উপজেলার বান্নিরচরের মেলায় এ প্রথা চালু আছে।
মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী মাতবর (৬৬) নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমার দাদার নাম আয়াত উল্লাহ। দাদা বলতেন, তাঁর বাবা-দাদারাও জন্মের পর থেকে এ মেলা দেখে আসছেন। আগে পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকি বিক্রি হতো। করোনার পর থেকে এটা কমে গেছে। এ মেলা ইজারা ও ডাকমুক্ত।’
নাসিরনগর সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য বিশ্বাস আলী বলেন, একসময় এ অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের জেলেদের বসবাস ছিল। তখন কাগজের মুদ্রার প্রচলন ছিল না। এ অঞ্চলের জেলেরা নিজেদের উৎপাদিত শুঁটকি নানা ফসলের বিনিময়ে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করতেন। সেই প্রথা থেকে এ শুঁটকির মেলা হয়ে আসছে। এ মেলার বয়স ৩০০ থেকে ৪০০ বছরের কম হবে না।