কুষ্টিয়ায় ছাত্রীর আত্মহত্যায় সমবেদনা জানাতে গিয়ে মারধরের শিকার প্রধান শিক্ষকের মামলা

কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ছাত্রীর জানাজায় সমবেদনা জানাতে গেলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রশিদকে রক্তাক্ত জখম করা হয়। গত মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার সুলতানপুর বেলতলা বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর আত্মহত্যার পর সমবেদনা জানাতে গিয়ে হামলায় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রক্তাক্ত জখম হওয়ার ঘটনায় মামলা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার পর কয়া ইউনিয়নের সুলতানপুর মাহতাবিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুর রশিদ নিজে বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এতে ৭ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ১৫-২০ জনেক আসামি করা হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এজাহারভুক্ত আসামিদের নাম প্রকাশ করেনি পুলিশ।

এর আগে গত বুধবার রাতে ওই বিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক ও আয়াকে আসামি করে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা করে মারা যাওয়া ছাত্রীর পরিবার। আসামিরা হলেন বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক মো. মশিউর রহমান (৪৫), কম্পিউটার বিষয়ের শিক্ষক ওয়ালিউর রহমান (৫০), মাহবুবা রহমান (৪০) ও আয়া শিউলি খাতুন (৪২)। মশিউর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ওয়ালিউর কয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও একই ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি।

দুটি মামলার কোনো আসামিকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি বলে জানিয়েছেন কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আকিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, দুটি মামলাকেই গুরুত্বসহকারে দেখছে পুলিশ। আসামিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

আরও পড়ুন

গত সোমবার বিকেলে উপজেলার কয়া ইউনিয়নের সুলতানপুর মাহতাবিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাদে ধূমপান করার অভিযোগ ওঠে ছয় ছাত্রীর বিরুদ্ধে। অভিযোগ করা হয়, স্মার্টফোনে ধূমপানের দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করেন বিদ্যালয়টির দুজন শিক্ষক ও একজন আয়া। ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ছাত্রীদের মারধর করে ব্যাগ কেড়ে নেওয়া হয়। এরপর টিসি (বদলির সনদ) ও অভিভাবকদের জানানোর ভয় দেখানো হয়। সেই অভিমানে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে সপ্তম শ্রেণির ওই ছাত্রী। আরেক ছাত্রী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।

গত সোমবার বিকেলে উপজেলার কয়া ইউনিয়নের সুলতানপুর মাহতাবিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাদে ধূমপান করার অভিযোগ ওঠে ছয় ছাত্রীর বিরুদ্ধে।

ওই ছাত্রীর পরিবারের অভিযোগ, শিক্ষকেরা ধূমপানের মিথ্যা অভিযোগ তুলে ছাত্রীদের মানসিক নির্যাতন করেছেন। সেই নির্যাতন সইতে না পেরে সপ্তম শ্রেণির ওই ছাত্রী আত্মহত্যা করে। তবে ঘটনার পর থেকে অভিযুক্ত শিক্ষকেরা দাবি করছেন, মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ পাওয়ায় তাঁরা ওই ছাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেন। কোনো ধরনের শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করেননি।

আরও পড়ুন

এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার মারা যাওয়া ওই ছাত্রীর জানাজার পাশাপাশি একটি মানববন্ধনের আয়োজন করেন ছাত্রীর স্বজন ও এলাকাবাসী। তখন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুর রশিদ সমবেদনা জানাতে সেখানে গেলে তাঁকে মারধর করা হয়। এ সময় আবদুর রশিদ রক্তাক্ত জখম হন। তিনি কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এ ঘটনায় গতকাল কুমারখালী থানায় তিনি মামলা করেন।

বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক এস এম আশরাফুল আলম বলেন, হামলার ঘটনায় প্রধান শিক্ষক বাদী হয়ে মামলা করেছেন। তিনি প্রকৃত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

এদিকে প্রধান শিক্ষকের ওপর হামলা ও সহকারী শিক্ষকদের নামে মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল শনিবার বিকেলে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কুষ্টিয়া হাউজিং বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান পরিষদ কুষ্টিয়া শাখা। সংগঠনটির কুষ্টিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমানের সভাপতিত্বে এ সময় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকেরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় বক্তব্য দেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নৃপেন চন্দ্র দাস; সহসভাপতি শফিউদ্দিন, মোহাম্মদ ফেরদৌস হেলাল, গৌতম কুমার সাহা ও রামকৃষ্ণ দাস; সাংগঠনিক সম্পাদক দুলাল চন্দ্র চৌধুরী প্রমুখ।

সভায় বক্তারা বলেন, একজন শিক্ষক জাতির বিবেক, সমাজ গড়ার কারিগর। তাঁর ওপর এমন হামলা জাতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়। তাঁরা হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানান। তাঁরা আরও বলেন, শিক্ষক-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছে, তা মিথ্যা, বানোয়াট। মামলা প্রত্যাহারের করতে হবে।

ধূমপানের অভিযোগে ‘শাসন’ এবং ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে তাদের জেলা প্রশাসককে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে কুমারখালী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আমিরুল আরাফাত গতকাল বলেন, ঘটনার গভীর তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।