বিশাল এলাকাজুড়ে বসেছে হাট। সকাল থেকেই সেখানে গরু নিয়ে আসা শুরু করেন খামারিরা। দুপুর হতেই ক্রেতা-বিক্রেতা আর ব্যাপারীদের হাঁকডাকে সরগরম হাট। হাটে মাঝারি ও বড় গরুর রেকর্ড সরবরাহ।
আজ বৃহস্পতিবার উত্তরবঙ্গের অন্যতম পশুরহাট বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার ধাপ সুলতানগঞ্জে গিয়ে এ চিত্র দেখা যায়। হাটের ক্রেতা–বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরবরাহ বেশি হওয়ার কারণে গত বছরের তুলনায় এবার মাঝারি গরুর দাম গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার এবং বড় গরুর দাম ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত কম। কমদামে গরু কিনতে পেরে খুশি ক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা। তবে বাজার মন্দায় মন খারাপ বিক্রেতা ও খামারিদের। খামারিরা বলছেন, গরু লালনপালনের খরচ বাড়লেও এবার দাম কমেছে। এতে খরচ উঠছে না।
কয়েক শ বছরের প্রাচীন ধাপ সুলতানগঞ্জ হাটে প্রতি বৃহস্পতিবার পশুর হাট বসে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে আজ লাখো পশু বিক্রির জন্য হাটে ওঠে। হাট ঘুরে দেখা যায়, দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা দামের বড় গরুর ক্রেতা ছিল কম। সেই তুলনায় ৭০ হাজার থেকে সোয়া লাখ টাকার মধ্যের মাঝারি আকারের গরুর ক্রেতা ছিল বেশি। দাম কম হওয়ায় অনেক খামারি অবিক্রিত গরু হাট থেকে ফেরত নিয়ে গেছেন।
ধাপ সুলতানগঞ্জ হাটের সবচেয়ে বড় ষাঁড়টির দাম সাড়ে ছয় লাখ টাকা হাঁকেন দুপচাঁচিয়া উপজেলার মথুরাপুর গ্রামের খামারি শফিকুল ইসলাম। কয়েকজন ক্রেতা পাঁচ লাখ পর্যন্ত দাম বলেন। শফিকুল ইসলাম বলেন, গত বছর কোরবানির হাটে এ আকারের ষাঁড় কমপক্ষে ১০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এবার দাম অর্ধেক। এ দামে ষাঁড় বিক্রি করে খরচ উঠবে না।
ধাপ সুলতানগঞ্জ হাটে খামারের একটি গরু ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেন বগুড়া সদর উপজেলার নামুজা গ্রামের খামারি তোতা মিঞা। তিনি বলেন, গত বছর এই আকারের গরু বিক্রি হয়েছে পৌনে দুই লাখ টাকায়। গত বছরের তুলনায় ২০ হাজার টাকা কম পেয়েছেন।
দেড় লাখ টাকায় একটি ষাঁড় বিক্রি করে লোকসানের কথা জানান নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার খামারি বিল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, এ গরু পুষতে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে, বিক্রি হয়েছে দেড় লাখ টাকায়। লাভ দুরে থাক, ২০ হাজার টাকা লোকসান দিতে হয়েছে।
গরুর বাজার মন্দায় বিক্রেতাদের মন খারাপ হলেও খুশি ক্রেতারা। দুপচাঁচিয়া সদরের জয়পুরপাড়ার ক্রেতা আবদুল মান্নান হাটে ৭৭ হাজার টাকায় একটি ষাঁড় কিনতে পেরে খুশি। তিনি বলেন, গত বছর এ আকারের গরু কিনতে হয়েছে ৯০ হাজার টাকায়। গত বছরের তুলনায় দাম কম। একই কথা জানান দুপচাঁচিয়ার সিংড়া বেলহতি গ্রামের আক্কেস আলী ও হাট সাজাপুর এলাকার রুহুল আমিন।
দুপচাঁচিয়া উপজেলার মোড় গ্রামের ব্যাপারী আবু মুসা প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর কোরবানির এ হাটে মাঝারি ও বড় গরুর চাহিদা বেশি থাকে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ফেনীসহ বড় বড় শহর থেকে ব্যবসায়ীরা এ হাটে গরু কিনতে আসেন। কিন্ত এবার হাটে বাইরের ব্যবসায়ীদের আনাগোনা কম। এর ফলে সরবরাহের তুলনায় গরুর ক্রেতা কম, দামও সস্তা। অনেক খামারি হাট থেকে গরু ফেরত নিয়ে গেছেন।
এবার খামারিদের খরচ উঠছে না বলে দাবি করেন বগুড়ার ভান্ডার অ্যাগ্রো অ্যান্ড ডেইরি খামারের মালিক তৌহিদ পারভেজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গোখাদ্য থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ বিল, শ্রমিকের মজুরি—সবকিছুর খরচ বেড়েছে। অথচ গত বছরের তুলনায় সব ধরনের গরুর দাম কমেছে।
বগুড়ার আরেক খামারি রাহাত খান বলেন, গত বছরের তুলনায় ১০০ থেকে ৩০০ কেজি ওজনের ষাঁড়ের দাম গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা কম। এ ছাড়া ৩০০ থেকে ৮০০ কেজি ওজনের গরুর দাম গত বছরের তুলনায় গড়ে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা কম। গত বছর খামারের বড় গরুর চাহিদা ছিল বেশি। এবার বড় গরুর চাহিদা কম, মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি।
ইচ্ছেমতো হাসিল আদায়
ধাপ সুলতানগঞ্জ হাটের ক্রেতা-বিক্রেতাদের অভিযোগ, হাটে ইজারাদারের লোকজন ইচ্ছেমতো হাসিল আদায় করছেন।
সাভার থেকে আসা মো. বারেক ২ লাখ ৫২ হাজার টাকায় ষাঁড় কিনেছেন। তিনি বলেন, প্রশাসন মাইকে ৫০০ টাকা হাসিল আদায়ের কথা বললেও ইজারাদারের লোকজন ১ হাজার টাকা আদায় করেছেন। প্রশাসনকে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি।
সাভার থেকে আসা আরেক ক্রেতা বায়োজিদ হোসেন বলেন, অন্য বছর বগুড়া থেকে গাবতলী হাট পর্যন্ত এক ট্রাক গরু পরিবহনে মহাসড়কে পথে পথে পাঁচ হাজার টাকার বেশি পুলিশ ও শ্রমিক সংগঠনকে চাঁদা দিতে হয়েছে। এবার মহাসড়কে গরুর ট্রাকে চাঁদাবাজি কমেছে। তবে হাটে হাটে ইজারাদারের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ। প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও ইজাদারদের চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। মহাস্থান, ধাপ সুলতানগঞ্জ থেকে শুরু করে বড় বড় হাটে একই চিত্র।
এ বিষয়ে দুপচাঁচিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জান্নাত আরা তিথি প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) সেখানে পাঠানো হয়েছিল। তিনি হাটে অভিযান চালিয়ে অতিরিক্ত হাসিল আদায়ের দায়ে ইজারাদারের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছেন।
বেড়েছে পরিবহন খরচ
এদিকে গরু পরিবহনের খরচও বেড়েছে। উত্তরের মহাস্থান, ধাপ সুলতানগঞ্জ, জয়পুরহাট ও পাঁচবিবি হাট থেকে কোরবানির গরু কিনে রাজধানীর গাবতলী গরুর হাটে বিক্রি করেন জয়পুরহাটের বুলুপাড়ার ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, মহাস্থান ও ধাপ সুলতানগঞ্জ হাট থেকে ১৫-২০টি গরু গাবতলী হাটে নিতে ট্রাকভাড়া ছিল ১৫ হাজার, পাঁচবিবি ও জয়পুরহাট থেকে গাবতলী পর্যন্ত ট্রাকভাড়া ছিল ১৭ হাজার টাকা। এবার গড়ে ২০টি গরু মহাস্থান ও ধাপ সুলতানগঞ্জ হাট থেকে গাবতলী পর্যন্ত নিতে ট্রাকভাড়া গুনতে হচ্ছে ২৫ হাজার টাকা, পাঁচবিবি ও জয়পুরহাট থেকে ট্রাকভাড়া ৩০ হাজার টাকা। পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবার কম দামে গরু কিনেও গাবতলী হাটে নেওয়ার পর খরচ বেড়ে গেছে।
মহাস্থান হাটের ট্রাকমালিক খাজা মিঞা বলেন, গত বছর এ হাট থেকে গরু পরিবহনে চট্টগ্রামের ট্রাকভাড়া ছিল ৩০ হাজার এবং ঢাকার গাবতলীর ভাড়া ছিল ১৫ হাজার টাকা। জ্বালানিসহ আনুষঙ্গিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় এ বছর কোরবানির পশু পরিবহনে মহাস্থান থেকে চট্টগ্রামের ভাড়া ৪০ হাজার এবং গাবতলীর ভাড়া ২৫ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে।