বিএনপির সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের কারণে শূন্য ঘোষিত বগুড়া-৬ (সদর) আসনে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন দলের ‘বিদ্রোহী’ ও মহাজোটের শরিক দলগুলোর প্রার্থীরা। বিএনপি ভোটে না থাকলেও দলটির একজন নেতা প্রার্থী হওয়ায় ভোটের হিসাব–নিকাশও পাল্টে যেতে পারে বলে মনে করছেন সাধারণ ভোটার ও দলীয় নেতা–কর্মীরা।
দলীয় সিদ্ধান্তে বিএনপির সংসদ সদস্য গোলাম মো. সিরাজ পদত্যাগ করায় শূন্য হওয়া বগুড়া-৬ আসনে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি উপনির্বাচনের ভোট গ্রহণের জন্য তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন পর্যন্ত ১৩ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। ৮ জানুয়ারি মনোনয়ন বাছাই করা হবে এবং ১৫ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সুযোগ থাকবে।
৪৩ বছর জয় পায়নি আওয়ামী লীগ
বগুড়ার রাজনৈতিক নেতা ও নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সদর আসন একসময় আওয়ামী লীগের দখলে ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এখানে আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছিল। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মাহমুদুল হাসান খান সর্বশেষ জয় পেয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়। এর পর থেকে আর জয় পায়নি আওয়ামী লীগ। ১৯৯০ সালের পর থেকে আসনটিতে প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পরে তাঁর ছেড়ে দেওয়া আসনটিতে উপনির্বাচনেও বিজয়ী হয়েছেন বিএনপির প্রার্থীরা।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে বিপুল ভোটে জয়ী হন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কিন্তু তিনি শপথ নেননি। পরে ২০১৯ সালের ২৪ জুনের উপনির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী ও জেলা বিএনপির তৎকালীন আহ্বায়ক গোলাম মো. সিরাজ প্রার্থী হন। সেই ভোটেও নৌকার প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি টি জামান নিকেতাকে হারান তিনি।
আগামী ১ ফেব্রুয়ারি উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান। বিএনপি–বিহীন এই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দাখিল করেছেন বগুড়া শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মান্নান আকন্দ। ২০২১ সালের বগুড়া পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে নৌকার বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ায় তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে ওই নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি ভোট পেয়ে আলোচনায় আসেন। ওই নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী জামানত হারান। এ ছাড়া জেলা পরিষদ নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, মান্নান আকন্দ পৌরসভা ও জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিপুল ভোট পেয়ে তাক লাগিয়েছেন। তিনি প্রার্থী হওয়ায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। এবারের উপনির্বাচনেও আওয়ামী লীগের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীও তিনিই।
আবদুল মান্নান আকন্দ বলেন, ‘জনগণের সুখে–দুঃখে সব সময় নানা সহায়তা নিয়ে পাশে আছি। অন্য প্রার্থীরা জনবিচ্ছিন্ন। অতীতে ভোট নিয়ে এলাকাবাসীর দুর্দিনে কেউ খোঁজ নেননি। এলাকার উন্নয়ন করেননি। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত হলে বিজয় সুনিশ্চিত। মানুষের আরও বেশি কল্যাণ ও এলাকার উন্নয়ন করতে পারব।’
তবে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রাগেবুল আহসান বলছেন, পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন ছিল। ফলে দলের অনেকেই আবদুল মান্নান আকন্দের দিকে ঝুঁকেছিলেন। এবারের উপনির্বাচনে তাঁর মনোনয়ন নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। দলের ভেতরে সবাই তাঁর পক্ষে আছেন। পেশাজীবীরাও সমর্থন দিচ্ছেন। ফলে এবার তিনি সুবিধাজনক অবস্থানেই আছেন।
আলোচনায় বিএনপির সাবেক নেতা
বগুড়া-৬ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন সদর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সরকার বাদল। বিএনপির সমর্থনে ২০১৪ সালে তিনি শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। জেলা বিএনপির সাবেক সদস্যও ছিলেন তিনি। সম্প্রতি বিএনপিতে তিনি উপেক্ষিত। তিনি স্বতন্ত্র থেকে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
ভোটাররা বলছেন, দীর্ঘদিন বিএনপির দখলে থাকা এই আসনে দলের সাবেক নেতা সরকার বাদল প্রার্থী হওয়ায় দলীয় ভোট টানতে পারেন। এতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন। বিএনপির ভোটার যত বেশি কেন্দ্রে আসবেন, আওয়ামী লীগের বিজয় তত কঠিন হয়ে পড়বে।
সরকার বাদল বলেন, ‘সাধারণ ভোটারের অনুরোধেই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছি। দলে বর্তমানে পদে নেই। দলীয় ভোটের বাইরেও অনেক ভোট পড়বে আমার পক্ষে। এতে বিজয় সহজ হবে।’
জেলা বিএনপির সভাপতি ও বগুড়া পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বলেন, এখন সেখানে দলীয় কোনো নেতার প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই। যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন, তাঁরা দলে কোনো পদে নেই। দলের সঙ্গে তাঁদের কোনো সর্ম্পকও নেই। এই ভোটে বিএনপির কোনো সমর্থক কেন্দ্রে যাবেন না।
জাসদ প্রার্থীকে নিয়ে ‘আশাবাদী’ আ.লীগ
বগুড়া-৪ আসনটি আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিয়েছে জোটের আরেক শরিক জাসদকে। এই আসনে জাসদের রেজাউল করিম তানসেন। বগুড়া-৬ আসনেও প্রার্থী দিয়েছে জাসদ। এখানে জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হক মনোনয়ন পেয়েছেন। জাসদ থেকে প্রার্থী দেওয়ায় শরিকদের ভোট টানা আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন হবে মনে করছেন দলীয় নেতা–কর্মীরা। এখানে মহাজোটের আরেক শরিক জাতীয় পার্টিও (জাপা) প্রার্থী দিয়েছে। নুরুল ইসলাম জাপার মনোনয়ন পেয়েছেন। অতীতে এই আসনে জাপাকে আওয়ামী লীগের সমর্থন দেওয়ার নজির আছে। এবার আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী দেওয়া হলেও জাপা ছাড় দেয়নি।
তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রাগেবুল আহসান আশা করছেন, শেষ পর্যন্ত জাসদের প্রার্থী ইমদাদুল হক মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেবেন। জাপার প্রার্থীর বিষয়ে তিনি বলেন, গাইবান্ধা উপনির্বাচনেও বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন জাপার মনোনীত প্রার্থী। এটাই গণতন্ত্র। তবে বগুড়া সদরে জাপার খুব বেশি ভোট নেই। ফলে জাপাকে নিয়ে তিনি চিন্তিত নন।
এই আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করা বাকিদের মধ্যে আছেন গণ ফ্রন্টের আফজাল হোসেন, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মনসুর রহমান, বাংলাদেশ খেলাফতে আন্দোলনের প্রার্থী মো. নজরুল ইসলাম, জাকের পার্টির প্রার্থী মো. ফয়সাল বিন শফিক, স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ কবির আহম্মেদ, আশরাফুল হোসেন (হিরো আলম), রাকিব হাসান ও সচেতন নাগরিক কমিটির জেলা কমিটির সভাপতি মাছুদার রহমান।