আধুনিক পলিনেট হাউসে চারা উৎপাদনে নাটোরের তরুণ উদ্যোক্তাদের চমক

পলিনেট হাউসে চারার পরিচর্যা করছেন উদ্যোক্তা রাজীব হোসেন। সম্প্রতি নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী দিয়াড় গ্রামেছবি: প্রথম আলো

বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সাদা রঙের মস্ত একটা ঘর। ওপরের অংশ দেখতে ঢেউখেলানো। প্রায় দোতলা উচ্চতার ঘরটির কাগুজে নাম ‘পলিনেট হাউস’। বিশেষ পলিথিন আর লোহার পাইপ-অ্যাঙ্গেল দিয়ে তৈরি এসব ঘরের ভেতরে চলছে নানা ধরনের সবজি চাষ আর ফুল, ফল ও সবজির চারা উৎপাদন। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা—সারা বছরই চলে চারা উৎপাদনের মহাযজ্ঞ।

নাটোর জেলার ছাতনী দিয়াড় ও মির্জাপুর দিয়াড় গ্রামে বছর দুয়েকের ব্যবধানে গড়ে উঠেছে এমন চারটি বড় ধরনের পলিনেট হাউস। পাশাপাশি একই এলাকা হলেও ছাতনী গ্রাম সদর উপজেলায় ও মির্জাপুর গ্রাম নলডাঙ্গায় পড়েছে। সম্প্রতি ওই এলাকা ঘুরে জানা যায়, উদ্যোক্তারা সবাই বয়সে তরুণ। পলিনেট হাউসে মানসম্মত চারা উৎপাদন করে তাঁরা সাড়া ফেলে দিয়েছেন। অর্জন করেছেন কৃষকের আস্থা। স্বল্প সময়ে তাঁরা নিজেদের বেকারত্ব ঘুচিয়েছেন। পাশাপাশি অনেক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

দুই বছরেই বাজিমাত রাজীবের

ছাতনী দিয়াড় গ্রামের ইউছুব প্রামাণিকের ছেলে রাজীব হোসেন অর্থাভাবে এসএসসির পর কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। বেকার ঘুরে বেড়াতেন। কৃষি বিভাগের মাঠকর্মীদের পরামর্শে ২০২১ সালে প্রশিক্ষণ নিয়ে ক্যাপসিকাম চাষ করেন। চার মাসে দেড় লাখ টাকা লাভও হয়। তখন সামান্য কিছু জমি বর্গা নিয়ে তরমুজ, ফুলকপি, টমেটো ও পেঁপে চাষ করেন। কিন্তু মানসম্মত চারা না পাওয়ায় লোকসানে পড়েন। এরপরই তিনি ঝুঁকে পড়েন চারা উৎপাদনে।

দুই লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে চারা উৎপাদন শুরু করেছিলেন রাজীব হোসেন
ছবি: প্রথম আলো

কথায় কথায় রাজীব জানান, রাজশাহী কৃষি প্রকল্পের আওতায় ২০২২ সালের শেষ দিকে তাঁকে একটি পলিনেট হাউস তৈরি করে দেয় কৃষি বিভাগ। মাত্র দুই লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ২০২৩ সালের শুরুতে সেখানে চারা উৎপাদন শুরু করেন। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত তিনি প্রায় ২৭ লাখ ৬০ হাজার টাকার চারা বিক্রি করেছেন। খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ ১১ হাজার টাকা। রাজীব হোসেনের পলিনেট হাউসে নিয়মিত ক্যাপসিকাম, ফুলকপি, টমেটো ও পেঁপের চারা উৎপাদিত হয়। এ ছাড়া মৌসুমভেদে করলা, স্কোয়াশ, তরমুজ ও শসার চারাও উৎপাদন করেন। তিনি কিছু জমি কেনার পাশাপাশি আরও সাত বিঘা জমি বর্গা নিয়েছেন। নতুন করে আরও একটি পলিনেট হাউস তৈরির কাজ শুরু করেছেন।

২৬ বছর বয়সী রাজীব হোসেন এখনো বিয়ে করেননি। সফলতা সম্পর্কে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন আমি চারা সরবরাহ করে শেষ করতে পারি না। সারাক্ষণ অনলাইনে চারার ফরমাশ আসছে। আমিই এই এলাকায় প্রথম পলিনেট হাউসে চারা উৎপাদন শুরু করি। আমাকে দেখে অন্য তরুণেরাও এই পেশায় ঢুকছেন। ভাবতে ভালোই লাগে।’

রাজীব হোসেন জানান, বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে বেশি দামে বীজ কেনেন। তাতে ভালো চারা হয়। কৃষকেরা সেই চারা কিনে সফলতা পান। এ ছাড়া কোকোপিট (মাটির পরিবর্তে নারকেলের ছোবড়ার ব্যবহার) পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করায় চারার শিকড় ছিঁড়ে যায় না। চারা টেকসই হয়। এ কারণে কৃষকদের আস্থা বেড়ে যায়।
ছাতনী গ্রামের প্রবীণ কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ছেলেটা (রাজীব হোসেন) আগে ঘুরে বেড়াত। হঠাৎ কৃষি অফিসে প্রশিক্ষণ নিয়ে পলিথিনের ঘর বানাল। ওই ঘরের মধ্যে এখন গাছগাছড়ার চারা করছে। চারার খুব চাহিদা। দূরদূরান্ত থেকে লোক এসে চারা নিয়ে যায়।’ রাজীবের সফলতা দেখে গ্রামের অন্য বেকার ছেলেরা নিজেরাই পলিথিনের ছোট ছোট ঘর করে চারা করছেন। তাঁরাও চারা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন বলে জানান সাইফুল ইসলাম।

ইলিয়াছের নার্সারিতে ২৫০ জাতের চারা

মা–বাবা একমাত্র ছেলে ইলিয়াছ শেখ এসএসসির পর কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারে অভাব-অনটন জেঁকে বসায় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার আগেই ঢাকায় পোশাক কারখানায় যোগ দেন। কিন্তু মানিয়ে নিতে না পেরে মির্জাপুর গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। বাবার দেওয়া কিছু পুঁজি নিয়ে মুদিদোকান দেন। পাশাপাশি কৃষিকাজে মনোনিবেশ করেন।

ফুল, ফল, সবজি ও ঔষধি মিলে নানা জাতের চারা উৎপাদন করেন ইলিয়াছ শেখ
ছবি: প্রথম আলো

পাশের গ্রামের রাজীব হোসেনের অনুপ্রেরণায় নিজেও শুরু করেন চারা উৎপাদন। উৎপাদিত চারা নিয়ে উপজেলা কৃষি মেলায় টানা তিনবার (২০২২-২৪) পুরস্কার পান। উৎসাহ বেড়ে যায়। তিনিও সরকারের কাছে পলিনেট হাউস তৈরির আবেদন করেন। সরকারি খরচে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ২৪ শতক জমিতে তাঁকে পলিনেট হাউস তৈরি করে দেওয়া হয়। শুরু করেন আধুনিক পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন।

ইলিয়াছের এখন দুটি পলিনেট হাউস রয়েছে। তিনি জানান, সাত প্রজাতির সবজির চারা উৎপাদনের মধ্য দিয়ে শুরু করলেও এখন তিনি ফুল, ফল, সবজি ও ঔষধি মিলে ২৫০ জাতের চারা উৎপাদন করেন। মানসম্মত চারা সরবরাহ করে তিনি ইতিমধ্যে কৃষকের মন ছুঁয়েছেন। তাই নার্সারির নামও দিয়েছেন ‘মনছোঁয়া পলিনেট হাউস অ্যান্ড নার্সারি’। ফেসবুক, ইউটিউব ও অনলাইন মার্কেটে তিনি এখন পরিচিত মুখ।

কথা বলতে বলতে ইলিয়াছ শেখের মুঠোফোনে একটু পরপর ফোন আসে। সবাই চারার ফরমাশ জানান। নার্সারি ঘুরে দেখা গেল, ইলিয়াছের নার্সারিতে পলিনেট হাউসে ও উন্মুক্ত পরিবেশে চারা উৎপাদন করা হচ্ছে। সবজিই সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে রয়েছে রঙিন ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, মরিচ, ক্যাপসিকাম, ব্রকলি, বিটরুট, ওলকপি, বোম্বাই মরিচ, নাগা মরিচ, কুমড়া, পেঁপে, ধুন্দুল। ফলের মধ্যে রয়েছে জাম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, পেয়ারা, আঙুর, ডালিম, বিভিন্ন জাতের আম প্রভৃতি। এ ছাড়া ফুলের মধ্যে আছে গোলাপ, মাধবীলতা, কুঞ্জলতা, গোল্ডেন শাওয়ার। ঔষধি গাছগাছড়ার মধ্যে হরীতকী, লজ্জাবতী, অশোক ও অ্যালোভেরা উল্লেখযোগ্য।
ইলিয়াছ শেখ বলেন, চারা উৎপাদনে বৈরী আবহাওয়া সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পলিনেট হাউসে সারা বছরই চারা উৎপাদন সম্ভব। রোগবালাই ও পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

এলাকাজুড়ে চারা উৎপাদনের কর্মযজ্ঞ

গত ২৮ সেপ্টেম্বর নাটোর শহরের উত্তর–পশ্চিমের নাটোর-মোমিনপুর সড়ক হয়ে রওনা দিয়ে দুই পাশে সারি সারি চারা বিক্রির দোকান দেখা যায়। সেগুলোতে শোভা পাচ্ছে নানা জাতের চারা। প্রায় তিন কিলোমিটার যেতেই ছাতনী এলাকায় সড়কের উত্তর পাশে দেখা যায়, কাটাখালী গ্রামের কদের আলীর বিশাল আকৃতির পলিনেট হাউস। সম্প্রতি করা এই পলিনেট হাউসে মূলত সারা বছর শসা, করলাসহ নানা জাতের সবজি উৎপন্ন হয়।

সেখান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার যেতেই রাজীব হোসেনের পলিনেট হাউস। সেখান দেখা গেল, রাজীব হোসেন মরিচের চারায় পানি দিচ্ছেন। ফুলকপি, বাঁধাকপি ও করলার চারাও চোখে পড়ল। প্লাস্টিকের ট্রেতে কোকোপিট পদ্ধতিতে উৎপন্ন করা চারাগুলো সারিবদ্ধ করে রাখা আছে। প্রতিটি চারাই সতেজ ও রোগমুক্ত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজীবের নার্সারিতে সাতজন, ইলিয়াছের নার্সারিতে ১২ জন ও কদেরের নার্সারিতে পাঁচজন নিয়মিত শ্রমিক কাজ করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় এলাকার আরও অনেকে নানা কাজের সুযোগ পান।

নলডাঙ্গা উপজেলা সদরের বাসিন্দা জহুরুল ইসলাম বাড়ির আঙিনায় ক্যাপসিকাম চাষ করেন। তিনি বলেন, আগে প্রতিবারই অন্তত অর্ধেক চারা মারা যেত। কিন্তু গত বছর রাজীব হোসেনের চারা লাগানোর পর সব কটিই টিকে গেছে। চারার শিকড় নষ্ট হয়নি। তিনি ও তাঁর ভাই আরও এক হাজার চারার বুকিং দিয়েছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা (উপপরিচালক) আবদুল ওয়াদুদ বলেন, রাজীব-ইলিয়াছরা একসময় বেকার ছিলেন। কৃষি বিভাগের প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁরা চারা উৎপাদন শুরু করে সফলতা পেয়েছেন। আধুনিক পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনের জন্য তাঁদের পলিনেট হাউস তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। মাঠকর্মীরা তাঁদের নিয়মিত প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন।