হাওরের সৌন্দর্যের টানে এসে হারাচ্ছেন প্রাণ

গত আড়াই মাসে শিশু, পর্যটকসহ ২০ জন মারা গেছেন বলে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে।

হাওরের স্বচ্ছ জলের ঢেউয়ের তালে মন মাতাতে অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে বিভিন্ন হাওরে নৌকায় ঘুরে বেড়ান
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

কিশোরগঞ্জের হাওরের বিস্তৃত জলরাশি যেন ‘মৃত্যুর দরিয়া’য় পরিণত হয়েছে। হাওরের পানিতে গোসল করতে নেমে শিশুসহ অনেকে মারা যাচ্ছেন। আবার হাওরের নয়নকাড়া সৌন্দর্যের টানে ছুটে এসে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেক পর্যটক। অসাবধানতা ও সাঁতার না জানায় বেশির ভাগ মৃত্যু ঘটছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা। বর্ষায় হাওরে নতুন পানি আসার পর গত আড়াই মাসে শিশু, পর্যটকসহ অন্তত ২০ জন মারা গেছেন বলে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে।

মিঠামইন সদরের সদরের স্থানীয় বাসিন্দা মোজাহিদুল ইসলামসহ কয়েকজন বলেন, কিশোরগঞ্জের হাওরবেষ্টিত উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, করিমগঞ্জ, নিকলীতে বেড়িবাঁধসহ কয়েকটি সেতু ও রাস্তা রয়েছে। এ ছাড়া হাওরের বুক চিরে তৈরি করা হয়েছে নয়নকাড়া রাস্তা। রয়েছে ডুবোসড়ক। দেশের নানা প্রান্তের ভ্রমণপিপাসুদের টেনে আনছে হাওরের অপরূপ এই সৌন্দর্য। এখানে এসে অনেক পর্যটক হাওর দেখার পাশাপাশি ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতার ও গোসলে নামেন। অনেকে নৌকায় দল বেঁধে ঘুরতে বের হন। এ সময় অনেকে নিরাপত্তার কথা ভুলে যান। অসাবধানতা ও সাঁতার না জানার কারণে সৌন্দর্য দেখতে এসে লাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন অনেকে।

সাঁতার না জানায় পানিতে নেমে কয়েকজন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। হাওরে বেড়াতে গেলে লাইফ জ্যাকেট পরা উচিত। আর সাঁতার জানলেও স্রোতে গোসল করতে না নামাই ভালো।
আবুজর গিফারী, জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশন, কিশোরগঞ্জ

ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত আড়াই মাসে হাওরে অন্তত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে গত সোমবার সন্ধ্যায় শখের বশে হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে মিঠামইন উপজেলা পল্লী বিদ্যুৎ কর্মকর্তা মো. হোসাইন হিমেল (২৯) পানিতে ডুবে নিখোঁজ হন। সোমবার সন্ধ্যায় ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম অল ওয়েদার সড়কের সেতুর কাছে জাল দিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে তিনি প্রবল স্রোতে তলিয়ে যান। প্রায় ২০ ঘণ্টা পর গত মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঘটনাস্থলের প্রায় এক শ গজ দূর থেকে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল নিখোঁজ হোসাইন হিমেলের লাশ উদ্ধার করে। তিনি নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজব্বার ইউনিয়নের চরহাসান গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।

১৪ জুলাই জেলা শহরের গাইটাল এলাকার বাসিন্দা হিমেল মিয়া (২৮) পরিবারের সঙ্গে হাওরে বেড়াতে গিয়ে করিমগঞ্জ-মিঠামইনের সংযোগস্থল হাসানপুর সেতুর কাছে গোসল করতে নামেন। একপর্যায়ে পানির স্রোতে তলিয়ে যান। পরদিন তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ১৬ জুন বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে নৌকা থেকে হাওরের পানিতে পড়ে যান কিশোরগঞ্জ সদর ছাত্রলীগের নেতা হাবিবুল্লাহ হাবিব (২৮)। দুদিন পর ঘটনাস্থলের অদূরে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৩ জুন ইটনায় নৌকাডুবিতে তাড়াইল দামিহা এলাকার মো. মাসুম মিয়া (২৫), করিমগেঞ্জর হালগড়া এলাকার মো. সিরাজ উদ্দিন (৩৫) ও ইটনার বেতেগাঁও এলাকার মো. ওয়াসীম মিয়া (৬০) মারা যান। এ ছাড়া গোসল করতে নেমে মো. সোহান (৬), শাবনুর (৮) ও সানজিদা (১১) পানিতে ডুবে মারা যায়। এভাবে গত আড়াই মাসে বিভিন্ন কারণে বর্ষার পানিতে তলিয়ে অন্তত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এর আগে ২০২০ ও ২০২১-এ হাওরের পানিতে ডুবে ২২ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু এ বছর মাত্র আড়াই মাসেই গত দুই বছরের মৃত্যুর রেকর্ড ছুঁয়েছে।

কিশোরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা আবুজর গিফারী বলেন, বর্ষায় কিশোরগঞ্জের হাওর ঘিরে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যায়। সাঁতার না জানায় পানিতে নেমে কয়েকজন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। হাওরে বেড়াতে গেলে লাইফ জ্যাকেট পরার পরামর্শ দেন তিনি। আর সাঁতার জানলেও স্রোতে গোসল করতে না নামাই ভালো।

এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, হাওরের যেসব জায়গা বিপজ্জনক, সেসব জায়গায় সতর্কতামূলক সাইন বোর্ড স্থাপনের পাশাপাশি নৌকায় ভ্রমণ ও পানিতে গোসলের বিষয়ে কড়াকড়ি করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।